নিখিল মানখিন: বইছে শীতের আবহাওয়া। শুরু হয়েছে খেজুরের রস সংগ্রহ। খেজুরের রসের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে প্রাণঘাতী নিপাহ ভাইরাস। নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ কার্যক্রম শুরু করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আর ডিসেম্বর থেকে শুরু হবে নিপাহ ভাইরাসের মৌসুম। মৌসুমের আগেই ভারতের একটি রাজ্যে নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। নিপাহ ভাইরাস সম্পর্কে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, এ রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। উপসর্গ দেখে চিকিৎসা করাতে হয়। দেশে এ রোগে আক্রান্তদের মৃত্যু ৮৯ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, দেশে সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। নিপাহ একটি ভাইরাসজনতি মারাত্মক রোগ, যা বাদুড় থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। আবার আক্রান্ত মানুষ থেকে মানুষেও সংক্রমিত হতে পারে। বাদুড়ে খাওয়া কাঁচা খেজুরের রস খেয়ে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয় অনেক মানুষ। দেশে ইতোমধ্যে খেজুরের রস সংগ্রহের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। সাবধানতা অবলম্বন না করলে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাবে না। কাঁচা খেজুরের রস এবং বাদুড় খাওয়া ফলমূলের অংশ বিশেষ না খাওয়ার জন্য পরার্মশ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রতি বছরই কিছু লোক নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও চিকিৎসকরা খেজুরের রস খাওয়ার ক্ষেত্রে সাবধান হওয়ার পরামর্শ দেয়া ছাড়া এ রোগ প্রতিরোধে কার্যকর কিছু করতে পারেননি। এ ভাইরাস ছড়ায় মূলত বাদুড়ের মাধ্যমে। শীতের সময় খেজুর গাছে বাঁধা রসের হাঁড়িতে বাদুড় মুখ দেয়। এ রোগে আক্রান্তদের মস্তিষ্কে ভয়াবহ প্রদাহ দেখা দেয়। নিপাহ ভাইরাসের প্রধান লক্ষণগুলো হলো জ্বরসহ মাথাব্যথা, খিঁচুনি, প্রলাপ বকা, অজ্ঞান হওয়াসহ কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ^াসকষ্ট।
চিকিৎসকরা জানান, বাংলাদেশে সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এ সময়েই খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। আর বাদুড় গাছে বাঁধা হাঁড়ি থেকে রস খাওয়ার চেষ্টা করে বলে ওই রসের সঙ্গে তাদের লালা মিশে যায়। আর সেই বাদুড় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে এবং সেই রস খেলে মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে এ ভাইরাস। আক্রান্ত মানুষ থেকে মানুষেও ছড়াতে পারে এ রোগ। জ¦রে আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীরা একপর্যায়ে সংজ্ঞা হারান এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের মৃত্যু হয়।
অন্যদিকে বিশে^ ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ায় সর্বপ্রথম নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়। তবে বর্তমানে বাংলাদেশকে এ রোগের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বিবেচনা করা হয়। ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত মেহেরপুর, নওগাঁ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ ও রংপুরে মানবদেহে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে। ২০০১ সালে দেশের উত্তর জনপদের সীমান্ত এলাকায় প্রথমবারের মতো নিপার প্রাদুর্ভাব দেখা যাওয়ার পর এ পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্ত ১৫২ জনের মধ্যে ১১৩ জনেরই মৃত্যু হয়েছে। এর রোগে আক্রান্তদের মৃত্যু ৮৯ শতাংশ।
নিপাহ ভাইরাস এতটাই সংক্রামক, ২০০৪ সালে ফরিদপুরে এক পরিবারের একজন আক্রান্ত হওয়ার পর ওই পরিবারের চারজনের মৃত্যু হয়। এক রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তার রিকশাচালকও নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হন। ২০১২ সালে এ রোগে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আর ২০১৫ সালে দেশের পঞ্চগড়, নীলফামারী, ফরিদপুর, মাগুরা, নওগাঁ ও রাজবাড়ীতে আক্রান্ত ৯ জনের মধ্যে ৬ জনেরই মৃত্যু ঘটে।
আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক ডা. মাহমুদুর রহমান ভোরের আকাশকে জানান, এ রোগটি অনেকটা ছোঁয়াচে হতে পারে। রোগীদের সংস্পর্শে যাওয়া ঠিক হবে না। কাঁচা খেজুরের রস এবং বাদুড় খাওয়া ফলমূলের অংশ বিশেষ না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ডা. মাহমুদুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, বলতে গেলে রোগটি পুরোপুরি ছোঁয়াচে। এ জ্বরে আক্রান্তকে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে নিতে হবে। আর চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এন্টিভাইরাস ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে রোগীকে আইসিইউতে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। রোগীর লালা, কফ-কাশি; এমনকি কাপড়চোপড়ের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কাঁচা খেজুরের রস এবং বাদুড় খাওয়া ফলমূলের অংশ বিশেষ খাওয়া ঠিক হবে না বলে জানান অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সতর্কবার্তায় বলা হয়, বাদুড়ের পান করা খেঁজুরের কাঁচা রসে বা আংশিক আহার করার ফলে বাদুড়ের লালা বা মলমূত্র মিশে থাকে। বাদুড়ের পান করা খেঁজুরের রস পান করলে বা আংশিক আহার করা বা কামড়ানো ফল খেলে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বাদুড়ের আংশিক আহার করা ফল অথবা ঘাস গরু, ছাগল, শূকর খেলে তাদের শরীরে নিপাহ ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে। বাদুড়ের লালা মলমূত্র মিশ্রিত কাঁচা খেজুরের রস পানে বাংলাদেশের কোন কোন জেলায় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে।
এদের মধ্যে কোন কোন অঞ্চলে নিপাহ সংক্রমিত রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তি নিপা আক্রান্ত হয়েছে। সংক্রমিত রোগীর হাঁচি-কাশি-কফ-থুথু অর্থাৎ শ^াসতন্ত্র এবং শরীরের সংক্রমিত নিঃসরণের মাধ্যমে নিপা একজন থেকে অন্যজনে সংক্রমিত হতে পারে।
সতর্কবার্তায় আরো বলা হয়, যেকোনো ফল খেতে হলে ভালোভাবে ধুয়ে শুকনো অবস্থায় খেতে হবে। কাঁচা শাকসবজি দিয়ে সালাদ খেতে হলে সেগুলোও ভালো করে ধুয়ে ও পরিষ্কার করে খেতে হবে। খেঁজুরের কাঁচা রস কোনো অবস্থায়ই পান যাবে না। সব অবস্থায় বাদুড়ের লালা, মলমূত্র এগিয়ে চলতে হবে। খেঁজুরের গুড়, রান্না করা খেঁজুরের রসের পায়েস, রান্না করা শাকসবজি নিরাপদ। নিপা আক্রান্ত রোগীর কাছে বিনা প্রয়োজনে কেউ যাবেন না। রোগী সেবার জন্য সঠিক সাবধানতা এবং সংক্রমণ প্রতিরোধমূলক প্রস্তুতি গ্রহণ করে কাউকে নির্দিষ্ট করুন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, প্রাক-নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ কার্যক্রম শুরু করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নিপাহ ভাইরাসের মৌসুম শুরু হওয়ার অনেক আগেই অবহিতকরণমূলক বিভিন্ন প্রোগ্রাম নেয়া হয়ে থাকে। গত কয়েক বছর ধরে নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার সংখ্যা তেমন নেই বললেই চলে। তবে সরকারি প্রস্তুতি রয়েছে।
ভোরের আকাশ/নি