সবাই তো চাষ করতে রাসায়নিক প্রয়োগ করছেন। রাসায়নিক ছাড়া নাকি চাষাবাদ সম্ভব না। যদিও তা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি। কিন্তু কি আর করা। ভালো ফলন পেতে তার তো বিকল্প নেই। কিন্তু সেটা ভুল। হ্যাঁ আসলেই ভুল, আর এটি যে ভুল তা প্রমাণ করেছেন দিনাজপরের ফুলবাড়ী উপজেলার কৃষক সোহরাব আলী মন্ডল।
তিনি করে দেখিয়েছেন যে, রাসায়নিক সার ছাড়াও প্রাকৃতিক উপায়ে চাষাবাদ করে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। তিনি প্রাকৃতিক উপায়ে ধান ও পটল চাষ করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন।
উপজেলার বেতদিঘী ইউনিয়নের নথন জামাদানী গ্রামের কৃষক সোহরাব আলী মন্ডল। তার এই অভিনব পদ্ধতিতে চাষ বেশ সাড়া ফেলেছে। রাসায়নিক সার ছাড়াই স্বল্প খরচে চাষাবাদে অধিক মুনাফা মিলবে। তাই তার দেখাদেখি এই পদ্ধতি অনুসরণ করছেন একই গ্রামের আরো ১০ কৃষক। আগামীতে সব কৃষক উদ্বুদ্ধ হবেন এই পদ্ধতিতে চাষাবাদে এই আশা সোহরাব মন্ডলের।
সরেজমিনে উপজেলার বেতদিঘী ইউনিয়নের নথন জামাদানী গ্রামের সোহরাব মন্ডল এর জমিতে গিয়ে দেখা যায় তিনি পটল তুলছেন। প্রতি সপ্তাহে তিনি চার মণ পটল বিক্রি করেন। একইভাবে তার আমন খেতের জমিতে ধানের শিষে ভরে গেছে। সোহরাব মন্ডলসহ ওই গ্রামের অন্য কৃষকরা কোনো রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার ছাড়াই তাদের আমনসহ পটল, কলা ও শীতকালীন শাকসবজি আবাদ করছেন। ১০০ দিনের মাথায় তাদের ধান ক্ষেত শিষে ছেয়ে গেছে।
ইতোমধ্যেই পটলে আশানুরূপ ফলন পেয়েছেন এবং বিক্রি করে বেশ মুনাফা করছেন কৃষক সোহরাব মÐল। একইসঙ্গে তিনি আমন ধানে ভালো ফলনের আশা করছেন। তার এই চাষের প্রক্রিয়ায় খরচ কম হওয়ায় অন্য কৃষকেরা আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
এসপিএনএফ (সুবাস পালাকার ন্যাচারাল ফার্মিং) পদ্ধতি অনুসরণ করে জামাদানী গ্রামের সোহরাব মন্ডল প্রথমেই তার ২০ শতাংশ জমিতে পটল চাষ শুরু করেন। ফলন ভালো ও খরচ কম হওয়ায় তার কাছে পরামর্শ নিয়ে ওই গ্রামের সেলিনা, বেলাল, এনামুল, মমতাজ, নুরুজ্জামান ও মান্নান চাষ করেছেন পটল, কলা এবং শীতকালীন শাকসবজি।
এতে কোনো রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়াই গোবর ও গোমূত্র দিয়ে বিশেষভাবে চাষ করেছেন তারা।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ক্রিশ্চিয়ান কমিশন ফর ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশের (সিসিডিবি) দিকনির্দেশনা ও সহযোগিতায় সোহরাব মন্ডল এই চাষাবাদ শুরু করেন ৫ মাস পূর্বে।
কৃষক সোহরাব আলী মন্ডল জানান, প্রথমে তিনি ২০ শতাংশ জমিতে সিসিডিবির সহযোগিতায় এসপিএনএফ পদ্ধতিতে পটল চাষ শুরু করেন প্রায় পাঁচ মাস পূর্বে। পরে পটলের আশানুরূপ ফলন পেয়ে আমন ধান ও কলা চাষ করছেন। এর মধ্যে কলাও ভালো হয়েছে। আমন খেতের শীষ দেখে মনে হচ্ছে ফলন ভালোই আসবে। ১৫ দিনের মধ্যেই ধান কাটতে পারবেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, এর আগে ওই জমিতে পটল চাষ করতেন রাসায়নিক সার ব্যবহার করে। তাতে তার খরচ হতো প্রায় ৪০ হাজার টাকা এবং পটল বিক্রি করতে পারতেন প্রায় এক লাখ টাকার। বর্তমানে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে তার পটল ক্ষেতে খরচ হয়েছে ১০ হাজার এবং পটলের ফলন ও বিক্রি হবে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা বলে আশা করছেন।
একইভাবে তিনি তুলনা করে বলেন, রাসায়নিক সার ব্যবহার করে এক বিঘা জমিতে আমন চাষে খরচ হয় প্রায় ৬ হাজার টাকা; আর এসপিএনএফ পদ্ধতিতে আমান চাষ করতে এক বিঘা জমিতে খরচ হবে মাত্র দেড় হাজার টাকা। এতে খরচ সাশ্রয়ী এবং লাভ বেশি হবে। তাই আগামীতে আমি আমার সব জমিই এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করব।
গ্রামের অপর কৃষক এনামুল ও বেলাল জানান, সোহরাব মন্ডল এর চাষাবাদ দেখে আমরা এই পদ্ধতিতে কলা চাষ করছি। ফলন দেখে আশা করা যাচ্ছে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যাবে। আগামীতে আমরা অন্যান্য চাষাবাদ এই পদ্ধতিতেই করব।
চাষ পদ্ধতি
এসপিএনএফ (সুবাস পালাকার ন্যাচারাল ফার্মিং) পদ্ধতিতে প্রথমে জীবামৃত ‘জীবামুরদ’ তৈরি করতে হয়। এতে ১০ কেজি গোবর, ১০ লিটার গোমূত্র, ১ কেজি চিটাগুড়, ১ কেজি বেসন ও পরিমাণমতো মাটি দিয়ে মিশ্রণ তৈরি করতে হয়। তিন দিন রাখার পর তা জীবামুরদে পরিণত হয়। পরে তা জমিতে প্রয়োগ করে চাষাবাদ করতে হয়।
সিসিডিবির দাউদপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক হরি সাধন রায় বলেন, ‘আমরা দেখেছি কৃষকদের একটা বড় অংক রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের পেছনে ব্যয় করতে হয়। তাতে কৃষকের লাভের অর্ধেক চলে যায়। এই অঞ্চলে প্রথমবার সোহরাব মন্ডল সহ কয়েকজন কৃষক আমন ধান, পটল, কলা, আলু, সরিষা এসপিএনএফ (সুবাস পালাকার ন্যাচারাল ফার্মিং) পদ্ধতিতে চাষ করেছেন।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রুম্মন আক্তার বলেন, জৈব পদ্ধতিতে সব চাষই ভালো। উপজেলার নথন জামাদানী গ্রামের কৃষকরা এসপিএনএফ (সুবাস পালাকার ন্যাচারাল ফার্মিং) পদ্ধতিতে চাষ করছে আমি শুনেছি। বিষয়টি সরেজমিনে দেখা হবে।
ভোরের আকাশ/নি