শাহীন রহমান: সম্প্রতি মিশরে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৭। কিন্তু এ সম্মেলন জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বিশ্বনেতারা সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেননি।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সমঝোতা না হলেও এটি বাংলাদেশসহ বিশ্বের এক বিরাট ঝুঁকি তৈরি করছে। বিশেষ করে নতুন নতুন সংক্রমণ আর রোগের আক্রমণের সুযোগ এনে দিচ্ছে এ পরিবর্তন। এর কারণে ৫৮ শতাংশ সংক্রমণ রোগ এখন গুরুতর আকার ধারণ করেছে।
সম্প্রতি সময়ে বাংলাদেশে মশাবাহিত রোগের প্রকোপ অনেক বাড়ছে। এর পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনই মূল কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি কার্বন নির্গমণ রোধ করা না যায়, তাহলে রোগ বহনকারী মশার বিস্তার আরো ভয়াবহ আকারে বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তারা বলছেন, রোগ বহনকারী মশা উষ্ণ পরিবেশে সহজে টিকে থাকতে পারে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অনেক দেশে; বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকার উঁচু অংশে এবং লাতিন আমেরিকায়ও ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু ক্রমেই বাড়ছে। যেখানে এ রোগ আগে ছিল না। এখন ইউরোপেও স্থায়ীভাবে ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়ছে, যা ২০ বছর আগেও অকল্পনীয় ছিল।
বিভিন্ন জরিপে বলা হয়েছে রোগ বহনকারী মশা নানা দেশে ছড়িয়ে পড়বে, যদি কার্বন নির্গমন না কমে। শুধু রোগে সংক্রমণ নয়। এর ফলে দেশের উপক‚লীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ও আগের চেয়ে বেড়েছে। এছাড়া বন্যা, খরা, নদী ভাঙনের মতো দুর্যোগও দেশে বাড়ছে।
দেশের বিশিষ্ট জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আতিক রহমান বলেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে হিমালয়ের বরফ গলছে দ্রুত। এ বরফগলা পানির বেশিরভাগ বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে নদী ভাঙনের সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও পরোক্ষভাবে নদী ভাঙনের জন্য এ জলবায়ু পরিবর্তনই দায়ী।
তিনি বলেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে গত শতাব্দীতে তাপমাত্রা ১.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এ শতাব্দীতে তা ৩.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে এ শতাব্দীতে জলবায়ু পরিবর্তনের এ প্রভাব দেশের ওপর আরো প্রকট হবে।
সদ্যসমাপ্ত আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত গরিব দেশগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তা দিতে একটি তহবিল গঠন করার বিষয়ে সম্মত হলেও কার্বন নিঃসরন কমানো এবং বৈশিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ধরে রাখতে সমঝোতায় আসতে পারেনি।
ফলে বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এটি কমাতে হলে জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার অবশ্যই কমাতে হবে। কিন্তু বিশ্বে বহু দেশ এতে সম্মত না হওয়ায় দ্ররিদ দেশে বিভিন্ন রোগ আর দুর্যোগের ঝুঁকি আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ শতকে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রির বেশি বাড়লে বিশ্বে মারাত্মক খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবে।
জাতিসংঘের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, এখনো তাপমাত্রা সেই কাক্সিক্ষত মাত্রায় ধরে রাখার মতো অবস্থায় নেই। বিশেষ করে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি।
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘একের পর এক রিপোর্টে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি পরিষ্কার ও অন্ধকার চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। দেশে গত ২০১৭ সাল থেকে মশা বাহিত রোগের প্রকোপ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এর সঙ্গে সারা বিশে^র পাশাপাশি বাংলাদেশে করোনাও মারাত্মক আকার ধারণ করে। বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছে দুটির মূল উৎসই জলবায়ুজনিত।
তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন হলে প্রাণীরাও জায়গা বদলায়। তারা জীবন ধারণের জন্য অধিকতর উপযুক্ত স্থানে চলে যায়। ফলে বিভিন্ন প্রাণীর দেহে বাস করা ভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার এবং মহামারি সৃষ্টি করার সুযোগ তৈরি হয়। কোভিডের ক্ষেত্রে এ ঘটনা দেখা গেছে। চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর প্রকোপের পেছনেও রয়েছে জলবায়ু পরিবতন জনিত ঘটনা।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবার থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে, যা ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশার প্রজননের জন্য সহায়ক। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনেক সময় পরিবেশই এ ভাইরাসগুলো সংক্রমণের সহায়ক হয়ে ওঠে। আর এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তরা শক সিন্ড্রোমে মারা যাচ্ছেন বেশি। শীতের মৌসুম শুরু হলেও ডেঙ্গুজ¦রের প্রকোপ আশঙ্কাজকনভাবে বাড়ছে, যার জন্য মূলত দায়ী জলবায়ু পরিবর্তন।
আন্তর্জাতির বিভিন্ন গবেষকরা উল্লেখ করছেন জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক বিরাট ঝুঁকি তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা যেমন বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বিশে^র উষ্ণায়ন বাড়ছে। আর পরিবেশে গরম বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যাকটেরিয়া ও রোগ সহজে ছড়াচ্ছে। গরম আবহাওয়ায় ব্যাকটেরিায়া সহজেই বাড়ছে। ফলে কিছু রোগও সহজে ছড়াচ্ছে।
কলেরার উদাহরণ টেনে তারা বলেন একটি বিপজ্জনক রোগ। এ ব্যাকটেরিয়া পানিতে শ্যাওলা জাতীয় উদ্ভিদে পাওয়া যায়। উষ্ণ পানিতে বংশ বৃদ্ধি করে। বন্যার মতো জলবায়ু সংশ্লিষ্ট দুর্যোগের সময় পানি বাহিত রোগ বেড়ে যায়। তা পোকা মাকড়কে আকষ্ট করে।
ঠিক যেমন খরার সময় অনিরাপদ পানির মজুত হয়ে থাকে। পানির এ নিরাপদ উৎস কমে যাওয়ার কারণে ডায়রিয়া রোগের প্রকোপ সম্প্রতি সময়ে দেশে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে গরম শুরু হলেই ডায়রিয়া প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ হলো অনিরাপদ পানি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ৩ মাস (জানুয়ারি-মার্চ) সারা দেশে ৪ লাখ ৬১ হাজার ৬১১ জন ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত হয়েছে। আইসিডিডিআর,বির তথ্যমতে, হাসপাতালে আসা রোগীদের ২৩ শতাংশ তীব্র ডায়রিয়া বা কলেরা রোগে আক্রান্ত। গরমকালে বর্ষা শুরু হওয়ার আগে এবং বর্ষা শুরু হওয়ার শেষে প্রতি বছরই ডায়রিয়া রোগ হয়ে থাকে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই সম্প্রতি সময়ে এসব রোগের প্রকোপ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। তারা বলছে, পৃথিবীতে শত শত কোটি ভাইরাস রয়েছে। তবে এগুলোর সবই বিপজ্জনক নয়। কিন্তু মানুষের জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো প্রস্তুত থাকা। সবাই মিলে এর প্রতিকারে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এছাড়া সবাইকে এমন টিকা ব্যবহার করতে হবে, যা এসব রোগের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।
ভোরের আকাশ/নি