নিখিল মানখিন: আওয়ামী লীগের রাজনীতির মারপ্যাঁচে পড়েছে বিএনপি। আনুষ্ঠানিকতা ও নিয়মনীতি বজায় রেখে বৈধ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে বেশ কৌশলে এগোচ্ছে আওয়ামী লীগ। এমনটি মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মহল।
তারা বলছেন, দৃশ্যমানভাবে ঢাকায় সমাবেশ করতে বিএনপির প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দিয়েছে সমাবেশের জায়গা। সমাবেশের দিন ঢাকা মহানগর এলাকায় কোনো কর্মসূচি রাখেনি দলটি। আর পরিবহন ধর্মঘট না ডাকার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
এসব সুবিধা দেয়ার বিপরীতে অনানুষ্ঠানিক ও অঘোষিত কিছু কর্মসূচি দিয়ে রেখেছে আওয়ামী লীগ। ওই দিন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সতর্ক পাহারায় থাকবে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
দেশের ৯টি বিভাগীয় গণসমাবেশ শেষে আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকার নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করতে চায় বিএনপি। এ জন্য দলটি ১৫ নভেম্বর ঢাকা মহানগর পুলিশকে (ডিএমপি) অনুমতি চেয়ে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু নয়াপল্টন নয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের মৌখিক অনুমতি দিয়েছে সরকার। আর নয়াপল্টনে সমাবেশ করার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে বিএনপি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনী রাজনৈতিক মাঠ দখলে হিসাব-নিকাশ করে এগোচ্ছে আওয়ামী লীগ। কৌশলে বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের সম্মেলন দেশবাসীর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিফল করে তোলাও এই রাজনীতিরই একটি অংশ।
আওয়ামী লীগের কৌশলী উদারতা : বিএনপিকে ঢাকায় ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই করতে হবে। নয়াপল্টনে দলটিকে সমাবেশ করতে না দেয়ার বিষয়ে অনড় সরকার। তাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্বিঘ্নে সমাবেশ করতে দেয়ার জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন দুদিন এগিয়ে আনা হয়েছে। এখানেও বিএনপির প্রতি উদারতা দেখিয়ে দেশবাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছে আওয়ামী লীগ।
রাজধানীতে বিএনপির গণসমাবেশ ঘিরে কেউ যেন পরিবহন ধর্মঘট ডাকতে না পারে, সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে আগামী ৬ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের সম্মেলন শেষ হওয়ার দুদিনের মধ্যেই সম্মেলন মঞ্চ ও প্যান্ডেল সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
এর আগে বিএনপির গণসমাবেশের নির্বিঘ্নে আয়োজনের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই ছাত্রলীগের সম্মেলনের তারিখ পূর্বঘোষিত ৮ ডিসেম্বর থেকে দুদিন এগিয়ে ৬ ডিসেম্বর আনা হয়েছে।
রোববার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এমন নির্দেশনা দেন। এখানে বিএনপির প্রতি উদারতা দেখিয়ে দেশবাসীর সুনাম কুড়িয়েছে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের মারপ্যাঁচ : রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজধানীতে জনসমাবেশ করার জন্য বর্তমানে সবচেয়ে উত্তম স্থানটি হলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এই স্থানটি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই বিএনপির। তবে ভেন্যু এলাকায় আওয়ামী আবহ বিরাজ করায় এবং এলাকাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে থাকায় বিএনপির নেতাকর্মীরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা বিশেষ করে শাহবাগ মোড় থেকে টিএসসি, দোয়েল চত্বর হয়ে কার্জন হল এলাকা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিচরণে মুখর থাকে। ফলে সমাবেশে আসা বিএনপি নেতাকর্মীদের মনে অবাধ বিচরণে ভয় কাজ করবে।
এ ছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চারদিক সীমানা প্রাচীরবেষ্টিত। কোনো কারণে বিশৃঙ্খলা, অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি হলে পালিয়ে যাওয়ার পথ সুগম হবে না ।
ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে থাকবে আওয়ামী লীগ : ২৩ নভেম্বর দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশের দিনে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সতর্ক পাহারায় থাকবে।
হেফাজতে ইসলাম যেভাবে বিশৃঙ্খলার অপচেষ্টা করেছিল, বিএনপি সে ধরনের বিশৃঙ্খলা করতে চায়। তারা গাড়ি-ঘোড়া ভাঙচুর, অগ্নিসন্ত্রাস এবং মানুষের সম্পত্তির ওপর হামলা করতে চায়। তারা দেশে একটি বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করতে চায়। মানুষ সেটি হতে দেবে না।
ছাত্রলীগের দখলে ৬ দিন : ডিসেম্বরের প্রথম ৬ দিন ছাত্রলীগের দখলে থাকবে রাজধানী ঢাকা। ফলে বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশ মোকাবিলায় প্রথম প্রতিরোধ শক্তি হিসেবে ছাত্রলীগকেই ব্যবহার করবে আওয়ামী লীগ। আগামী ৬ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সম্মেলন।
সংগঠনটির ঢাকা মহানগর সম্মেলন ২ ডিসেম্বর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সম্মেলন হবে ৩ ডিসেম্বর। ফলে ১ থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পদপ্রত্যাশী ছাত্রলীগ নেতা এবং তাদের সমর্থকদের পদচারণায় মুখর থাকবে রাজধানী। বিশেষ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকা।
এ সুযোগেই নগরীর পাড়া-মহল্লায় অবস্থান নেবেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কেন্দ্রীয় সম্মেলন কেন্দ্র করে সারা দেশ থেকে ছাত্রলীগের হাজার হাজার নেতাকর্মীর আগমন ঘটবে রাজধানীতে। সৃষ্টি হবে জনসমুদ্র। সম্মেলনের অজুহাতে নগরীর রাস্তাঘাট, অলিগলি ও পাড়া-মহল্লায় অবস্থান নেবেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
মহানগর আওয়ামী লীগের কর্মসূচি : রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরো জানান, ঢাকা মহানগর এলাকায় সমাবেশ কর্মসূচি না থাকলেও সাভারে জনসভা করবে আওয়ামী লীগ। সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ে তিন থানার আয়োজনে জনসভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য দেবেন। জনসভায় বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী জমায়েত করার প্রস্তুতি চলছে।
ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম ভোরের আকাশকে বলেন, ‘রাজধানী ঢাকায় আমরা পাল্টাপাল্টি কোনো কর্মসূচি দিচ্ছি না। ঢাকার অদূরে সাভারে তিন থানার আয়োজনে যে জনসভা আহŸান করা হয়েছে, সেটি বেশ আগে থেকেই নির্ধারণ করা। ’
এ ছাড়া আগামী ৯ ডিসেম্বর রাজধানীতে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখা। এদিন বিকেল ৪টায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণে স্টেডিয়ামের ২ নম্বর ফটকের সামনে এ সমাবেশ হবে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, ‘আমাদের নেতাকর্মীরা সতর্ক অবস্থানে থাকবে। যেন কোনো নির্দেশ দিলেই নাশকতা প্রতিরোধে মাঠে নামতে পারে। ডিসেম্বরজুড়ে থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে সভা-সমাবেশের কর্মসূচি পালন করবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ। এসব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বিরোধী দলের যে কোনো আন্দোলন কর্মসূচি মোকাবিলায় নেতাকর্মীদের প্রস্তুত রাখা হবে।
রোববার দলীয় অনুষ্ঠানে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশ নিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, ‘১০ ডিসেম্বর কিছুই হবে না। ওই দিন আমরাও মাঠে থাকব। তাদের (বিএনপি) কোনো বাধা দেব না। কিন্তু তারা যদি আগুন নিয়ে খেলতে চান, লাঠি নিয়ে খেলতে চান, তাহলে আমরা তা হতে দেব না। বিএনপির সঙ্গে খেলা হবে।’
ভোরের আকাশ/নি