মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: একসময় বিয়েতে কন্যা বা বধূকে স্বর্ণ দেয়ার চল ছিল। মেয়েকে সাধ্যমতো স্বর্ণালংকার দিয়ে শশুরবাড়ি পাঠাতে পারলেই স্বস্তি পেত কন্যাপক্ষ। পক্ষান্তরে পাত্রপক্ষেরও চেষ্টা থাকত নববধূকে সন্তোষজনক স্বর্ণ-গহনা দিয়ে ঘরে তোলা।
এ ছাড়া বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানেও স্বর্ণের গহনা উপহার দেয়ার রীতি প্রচলন ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই রীতিতে বদল এসেছে। স্বর্ণের দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে স্বর্ণের চল উঠে যেতে বসেছে। নিন্মবিত্তের বিয়ে তো দূরের কথা, মধ্যবিত্তের বিয়েতেও স্বর্ণ এখন সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে। বাধ্য হয়ে সিটিগোল্ড দিয়েই চাহিদা মেটাতে হচ্ছে দুই পক্ষকেই।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) দেয়া তথ্যমতে, ১৯৭১ সালে দেশে প্রতি ভরি গিনি স্বর্ণের দাম ছিল ১৭০ টাকা। বর্তমানে এর দাম ৮৪ হাজার ২১৪ টাকা। সে হিসাবে গত ৫১ বছরে প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম বেড়েছে ৪৯৫ গুণের বেশি।
সর্বশেষ দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)। ভালো মানের স্বর্ণের দাম প্রতি ভরিতে বেড়েছে দুই হাজার ৩৩২ টাকা। নতুন দাম অনুযায়ী ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনার দাম বেড়ে হয়েছে ৮৪ হাজার ২১৪ টাকা, যা এতদিন ছিল ৮০ হাজার ১৩২ টাকা। এটা সর্বশেষ বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে আরো বেশি।
জানতে চাইলে ফার্মভিউ সুপার মার্কেটের গোল্ডস্টার জুলেয়ার্সের সৌরভ কর্মকার ভোরের আকাশকে বলেন, দফায় দফায় স্বর্ণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন এর চাহিদা কমে গেছে। বলতে গেলে নি¤œবিত্ত বা মধ্যবিত্ত তো এখন স্বর্ণের নাম ভুলেই গেছেন। উচ্চবিত্তের বিয়েতে এখনো কিছু স্বর্ণ দেয়া হচ্ছে, তার পরিমাণও খুব কম।
আগে অনেক কাস্টমার অনুষ্ঠানে উপহার দেয়ার জন্য চেইন, কানের দুল, বালা কিনতেন। এখন এ ধরনের কাস্টমার খুবই কম। যারা আসেন তারা দুই আনা-তিন আনার আংটি বা কানের দুল খোঁজেন। তিনি বলেন, বিশ্ব বাজারে স্বর্ণের দামে অস্থিরতা রয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এর একটি কারণ। সব মিলে আমাদের ব্যবসার অবস্থাও ভালো নেই।
সম্প্রতি বাজুসের মূল্য নির্ধারণ ও মূল্য পর্যবেক্ষণ স্থায়ী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান এনামুল হক ভূইয়া লিটনের সই করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয় ভালো মানের ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণ কিনতে খরচ পড়বে ৮২ হাজার ৪৬৪ টাকা। ২১ ক্যারেটের স্বর্ণের দাম ভরিপ্রতি নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৮ হাজার ৭৩২ টাকা। ১৮ ক্যারেটের প্রতি ভরির দাম পড়বে ৬৭ হাজার ৪৭৬ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ হাজার ৫২০ টাকা।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৯৭১ সালে প্রতি ভরি গিনি স্বর্ণের দাম ছিল ১৭০ টাকা। দশ বছরের ব্যবধানে ১৯৮০ সালে দাম হয় ৩ হাজার ৫০ টাকা। যেখানে বৃদ্ধির হার ২১৩ শতাংশ। এর পরবর্তী ১০ বছরে আরো দুগুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪০০ টাকায়। আর ২০০০ সালে ২২ ক্যাডমিয়াম প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ছিল ৬ হাজার ৮০০ টাকা। সে হিসাবে ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল এই এক দশকে স্বর্ণের দাম বৃদ্ধি পায় মাত্র ৪০০ টাকা।
বলা চলে, এ সময়ে স্বর্ণের মূল্য অনেকটা স্থিতিশীল অবস্থায় ছিল। আর ২০১০ সালে ২২ ক্যাডমিয়ামের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ছিল ৩৬ হাজার ১০০ টাকা। অর্থাৎ ২০০০ সালের পরবর্তী ১০ বছরে আরেক দফা লাফ দেয় স্বর্ণের দাম। ভরিপ্রতি দর বাড়ে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। যার হার প্রায় ছয়গুণ।
পরে ২০১১ সালে এর দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯ হাজার ৪৫৫ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে মূল্য বৃদ্ধি পায় ১৩ হাজার ৩৫৫ টাকা। আর সর্বশেষ চলতি বছরে দাম বেড়ে স্বর্ণের ভরি ৮৫ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বললে আলমগীর হোসেন (ছদ্মনাম) নামে এক ব্যাক্তি ভোরের আকাশকে জানান ‘তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ২৩ ডিসেম্বর বিয়ের পিঁড়িতে বসবেন। বাগদত্তার জন্য তিনি স্বর্ণের গহনা বলতে নাকফুল এবং চার আনার কানের দুল কিনেছেন। তিনি জানান, নতুন বউকে আরো গয়না দেয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সাধ থাকলেও সাধ্য নেই। সংশ্লিষ্টরা জানান, এখন অনেকেই বিয়েতে স্বর্ণ বলতে শুধু নাকফুল দিচ্ছেন। বাকি কাজ সারছেন সিটিগোল্ড দিয়ে।
বেড়েছে সিটিগোল্ডের চাহিদা : যাদের স্বর্ণের ধারেকাছে যাওয়ার সাধ্য নেই, তাদের কাছে দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর মতো অত্যন্ত পছন্দের গরিবের সোনা সিটিগোল্ড। কম দামে পাওয়া যাওয়ায় সিটিগোল্ডে ঝুঁকছেন মধ্যবিত্ত-নিন্ম বিত্তরা। ১০০ টাকায় কানের দুল, ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় এক জোড়া বালা, ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় সীতাহার বা চেইন পাওয়া যায়। ৫০০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায় নতুন বউয়ের গহনার পুরো সেট।
বিষয়টি নিয়ে কথা বললে তসলিমা আক্তার নামে এক নারী বলেন, নতুন বউকে সাজানোর জন্য অনেক গহনা প্রয়োজন। কিন্তু বেশিরভাগ পরিবারই এখন এটা দিতে পারছেন না। সে কারণে সিটিগোল্ড দিয়েই বউ সাজাতে হচ্ছে। কারণ যে কোনো গয়না হোক, বিয়ের দিন কন্যকে না জানালে যেন বিয়ের পরিপূর্ণতা আসে না।
অন্যদিকে স্বর্ণের দাম বাড়লেও রুপার দাম আগের মতো অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ক্যাটাগরি অনুযায়ী ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি রুপার দাম এক হাজার ৫১৬ টাকা, ২১ ক্যারেটের রুপার দাম এক হাজার ৪৩৫ টাকা, ১৮ ক্যারেটের রুপার দাম এক হাজার ২২৫ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির রুপার দাম ৯৩৩ টাকায় অপরিবর্তিত আছে।
ভোরের আকাশ/নি