logo
আপডেট : ৩ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৯:২৮
বাকপ্রতিবন্ধী তুষারের এসএসসি পাশের গল্প
আশরাফুল ইসলাম সুমন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

বাকপ্রতিবন্ধী তুষারের এসএসসি পাশের গল্প

আশরাফুল ইসলাম সুমন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া:  চলতি বছর এসএসসি পাশ করছে বাকপ্রতিবন্ধী তুষার । ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিজয়নগর উপজেলার চম্পকনগরে জন্মগ্রহণ করা বাকপ্রতিবন্ধী তুষার ইমরান চৌধুরী চার বোন এক ভাইয়ের মাঝে সবার বড়। বাবা কলেজ শিক্ষক আর মা মাছুমা ইয়াছমিন একজন গৃহিণী। তুষার ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া এসএসসি পরীক্ষায় চম্পকনগর মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে জিপিএ ৩.১৭ পেয়ে পাশ করেছেন। বোবা ছেলের এমন সাফল্যে পুরো এলাকায় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

 

স্কুলের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই ভীষণ খুশি। বিদ্যালয়ের চলতি দায়িত্বে থাকা সহকারী প্রধান শিক্ষক কামাল স্যার খুবই উচ্ছ্বসিত।

 

নিজের ছাত্র সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন, ‘ষষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত আমাদের স্কুলে পড়াশোনা করেছে। শিক্ষক এবং সহপাঠীরা সবসময় সহযোগিতা করেছে তাকে। বাকপ্রতিবন্ধী হয়েও সে অন্যদের মতোই ভালো রেজাল্ট করেছে। এটা নিশ্চয় তার নিজের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ অর্জন হয়ে থাকবে’।

 

তুষারের বাবা চম্পকনগর উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী কলেজের সহকারী অধ্যাপক লুৎফর রহমান (লিটন) ছেলের সফলতায় আবেগাপ্লুত।

 

তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত আসতে আমাকে এবং তার মাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। ধৈর্য্যর প্রতিবিম্ব হয়ে দিন-রাত তার পেছনে শ্রম দিতে হয়েছে। মনের দিক থেকে কখনো দুর্বল হইনি’।

 

ছেলের কথা বলতে গিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘ছোট সময়ে সে একবার রাস্তায় মারাত্মকভাবে এক্সিডেন্ট করে। হাঁটুর নিচের অংশ একেবারে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। সুস্থ হওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। আল্লাহর ওপর ভরসা করে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছি’। তিনি স্কুলের শিক্ষক এবং তার সহপাঠীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

 

তুষারের মা মাছুমা ইয়াছমিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘তাকে অক্ষর চিনাতেই আমাদের এক বছর সময় লেগেছে। ১০ জনের শ্রম একজনকে দিতে হয়েছে। তবু বাবা-মা হিসেবে আমরা কখনো হাল ছাড়িনি। আমাদের কষ্ট সার্থক হয়েছে। আজ আমরা অনেক খুশি’। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, প্রথমে বাড়ির নিকটবর্তী ইকরা কিন্ডার গার্ডেন স্কুলে ভর্তি করা হয় তাকে। সেখানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে। প্রাথমিক সমাপনীতে জিপিএ ৪.৮৩ পেয়ে পাশ করে। অল্পের জন্য এ প্লাস থেকে বঞ্চিত হয়। এরপর চম্পকনগর মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়।

 

অষ্টম শ্রেণিতে অনুষ্ঠিত হওয়া জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৩.৫৬ পেয়ে পাশ করে। সর্বশেষ একই প্রতিষ্ঠানে এসএসসিতে মানবিক বিভাগ থেকে ৩.১৭ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। উল্লেখ্য, ২০২০ সালে এই বিদ্যালয় থেকেই তুষারের এক বোন তাশবিহ্ চৌধুরী তুশিবা এসএসসিতে মানবিক বিভাগ থেকে সাধারণ গ্রেডে বোর্ড স্কলারশিপসহ জিপিএ ৫ পেয়ে পাশ করেছিলেন।

 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় মূক-বধিরদের জন্য একটিমাত্র স্কুল রয়েছে।

 

স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. তাজুল ইসলাম ভূঁইয়া এই প্রতিবেদককে বলেন, আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া মূক ও বধির স্কুলে প্রায় দুই যুগ ধরে আছি। ২০১০ সাল থেকে এই স্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে আসছি। তুষারকে আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া মূক-বধির প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা। আমরা অচিরেই তার বিষয়ে খোঁজখবর নিব। বোবাদের আমি দীর্ঘদিন ধরে খুব কাছ থেকে দেখে আসছি। এটি একজন বাকপ্রতিবন্ধী ছেলের জন্য অনেক বড় অর্জন। আমি তুষারের বাবা-মা এবং শিক্ষকদের ধন্যবাদ জানাই।

 

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন চৌধুরী চম্পকনগর ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে তাকে উৎসাহিত করতে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করার ঘোষণা দেন।

 

এ সম্পর্কে বিজয়নগর উপজেলা শিক্ষা অফিসার আ. জলিল মুঠোফোনে প্রতিবেদককে বলেন, এটি নিঃসন্দেহে অসাধারণ বিষয়। উচ্চ শিক্ষার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে তাকে সবরকম সহযোগিতা করা হবে। আমি তার উত্তরোত্তর সফলতা কামনা করছি। সুস্থ, স্বাভাবিক ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করাতে গিয়ে অনেকসময় বাবা-মাকে বেশ বেগ পেতে হয়, ব্যর্থ হতে হয়। শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার বা উন্নয়নে কথা বলতে না পারা একজন বাকপ্রতিবন্ধী তুষার আর তার পিতা-মাতা হতে পারে অনন্য উদাহরণ।

 

ভোরের আকাশ/আসা