নিখিল মানখিন: ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার কাকরকান্দি গ্রামের বাসিন্দা মো. গিয়াসউদ্দিন (৪৫)। বুকে ব্যথা অনুভব করায় তিনি গত মাসের প্রথমদিকে রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে আসেন। সেখানে ইসিজি, ইকো, এক্সরে, ইটিটি পরীক্ষার পাশাপাশি রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা পরিমাপ করা হয়।
এতে জানা যায়, তার হৃদরোগ নেই। গ্যাস্ট্রিকের কারণে তার বুকে ব্যথা হচ্ছে। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে মেডিসিন বিশেষজ্ঞকে দেখানো হলে রোগীর চিকিৎসা উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালেই সম্ভব ছিল বলে জানানো হয়। এভাবে রোগী রেফারেল পদ্ধতি চালু না থাকার কারণে সময় ও অর্থের অপচয় হচ্ছে। ভোগান্তিতে পড়ার পাশাপাশি যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে অনেকে অকাল মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, রোগী রেফারেল পদ্ধতি চালু না থাকায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হাজার হাজার রোগী এভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। রোগের প্রাথমিক পরামর্শের জন্য রোগী কোথায় যাবেন, কোন চিকিৎসকের তত্ত¡াবধানে চিকিৎসা নেবেন, কতটুকু অসুস্থ হলে কোন পর্যায়ের হাসপাতাল কিংবা বিশেষজ্ঞের কাছে যাবেন স্বাস্থ্য বিভাগের এ-সংক্রান্ত কোনো গাইডলাইনই নেই।
এ অবস্থায় রোগী নিজের সিদ্ধান্তেই বড় হাসপাতাল ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগী ভুল করে অন্য রোগের বিশেষজ্ঞের কাছে যান।
বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, এভাবে বড় হাসপাতাল ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রোগী অযথাই ভিড় করছেন। রোগীর যেমন মানসিক, শারীরিক ও আর্থিক অপচয় ঘটছে, তেমনি ঘটছে চিকিৎসকের মেধার। এ অবস্থা নিরসনে বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসা ক্ষেত্রে স্ট্রাকচারাল রেফারেল পদ্ধতি চালুর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
তবে বারবার উদ্যোগ নেয়া হলেও দীর্ঘদিনেও এ পদ্ধতি চালু করা সম্ভব হয়নি। কেন এ পদ্ধতি চালু করা যাচ্ছে নাÑ এমন প্রশ্নে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের এ পদ্ধতিটি চালুর বিষয়ে অনীহা রয়েছে, তেমনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কার্যকর উদ্যোগ নেই। এ কারণে আলোচনা হলেও বিষয়টি এগোচ্ছে না।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ ভোরের আকাশকে বলেন, কার্যকর রেফারেল পদ্ধতি রোগী ও চিকিৎসক উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করে। এ পদ্ধতি না থাকায় রোগী সরাসরি টারশিয়ারি হাসপাতাল এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে পারছেন না।
সঠিক চিকিৎসাসেবা গ্রহণের কার্যকর নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। প্রাথমিক স্তর থেকে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবার স্তর পর্যন্ত যেতে নানা অজানা পথ পাড়ি দিতে গিয়ে নানাভাবে বিভ্রান্ত ও হয়রানির শিকার হতে হয় রোগীদের। এভাবে রোগীর যেমন মানসিক, শারীরিক ও আর্থিক অপচয় ঘটছে, তেমনি অনেক সময় সঠিক সময়ে প্রত্যাশিত চিকিৎসাসেবা না পেয়ে অনেক রোগী অকালে মারা যায় বলে জানান ডা. এম এ আজিজ।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা জানান, বর্তমানে দেশে ওয়ার্ডভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন সাব সেন্টার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন টারশিয়ারি ও বিশেষায়িত হাসপাতাল চালু রয়েছে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেও চিকিৎসার জন্য সরাসরি ঢাকায় চলে আসছেন।
অথচ প্রথমে তার কমিউনিটি ক্লিনিক অথবা ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার কথা। সেখানকার নির্দেশনা অনুযায়ী যাওয়ার কথা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এরপর পর্যায়ক্রমে জেলা, বিভাগ এবং সবশেষে টারশিয়ারি ও বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসার কথা।
রেফারেল পদ্ধতি সম্পর্কে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা জানান, বর্তমানে দেশে ওয়ার্ডভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন সাব সেন্টার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন টারশিয়ারি ও বিশেষায়িত হাসপাতাল চালু রয়েছে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেও চিকিৎসার জন্য সরাসরি ঢাকায় চলে আসছেন।
অথচ প্রথমে তার কমিউনিটি ক্লিনিক অথবা ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার কথা। সেখানকার নির্দেশনা অনুযায়ী যাওয়ার কথা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এরপর পর্যায়ক্রমে জেলা, বিভাগ এবং সবশেষে টারশিয়ারি ও বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসার কথা।
সরকারি হাসপাতাল থেকে সরকারি হাসপাতালে, বেসরকারি হাসপাতাল থেকে সরকারি হাসপাতালে এবং সরকারি হাসপাতাল থেকে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য রোগী রেফারেল পদ্ধতির মাধ্যমে চিকিৎসা নিতে পারেন। অর্থাৎ যে রোগীর যেখানে সুচিকিৎসা নিশ্চিত হবে, এটি তাকে সেখানে পাঠানোর একটি ব্যবস্থাপনা।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব ভোরের আকাশকে বলেন, কার্যকর রেফারেল পদ্ধতি রোগী ও চিকিৎসক উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করে। এ পদ্ধতি না থাকায় রোগী সরাসরি টারশিয়ারি হাসপাতাল এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে পারছেন না। রেফারেল পদ্ধতি চালু না থাকায় সঠিক চিকিৎসাসেবা গ্রহণের কার্যকর নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত রোগীরা।
তিনি বলেন, রেফারেল সিস্টেম চালু না থাকায় যে রোগীর মেডিসিনের চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা, সে যাচ্ছে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে; গ্যাস্ট্রোলজির রোগী যাচ্ছে মেডিসিনের চিকিৎসকের কাছে। এতে রোগীর আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, সময় নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি হাসপাতাল ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চেম্বারে অপ্রয়োজনীয় ভিড় জমছে। প্রকৃত রোগীর স্বাস্থ্যসেবাও বিলম্বিত হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, কার্যকর রেফারেল পদ্ধতি চালু না থাকায় টারশিয়ারি ও বিশেষায়িত হাসপাতালে অতিরিক্ত রোগী ভিড় করছেন।
এ তালিকায় রয়েছে ঢাকা মেডিকেল, মিটফোর্ড, সোহরাওয়ার্দীর পাশাপাশি হৃদরোগ, কিডনি, চক্ষুবিজ্ঞান, নিউরো সায়েন্স, জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন সরকারি টারশিয়ারি ও বিশেষায়িত হাসপাতাল। এসব হাসপাতালে শয্যাসংখ্যার তুলনায় অতিরিক্ত রোগী ভিড় জমাচ্ছেন। নামিদামি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারেও রোগীর উপচেপড়া ভিড় জমছে।
এসব চিকিৎসক ব্যক্তিগত চেম্বারে দৈনিক মাত্র তিন-চার ঘণ্টায় গড়ে ২০০-৩০০ রোগীর ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন! দেশের দুটি শীর্ষস্থানীয় সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতেও রোগীর উপচেপড়া ভিড়। অনেক রোগী আছেন যাদের চিকিৎসা অন্য কোনো সাধারণ হাসপাতালেও সম্ভব। কিন্তু রেফারেল পদ্ধতি কার্যকর না থাকায় অনেক রোগী বুঝতে পারেন না, তাদের কোথায় যাওয়া উচিত বলে জানান অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ব বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ ভোরের আকাশকে বলেন, রেফারেল পদ্ধতিতে একজন সাধারণ চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য রোগীকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পাঠান, একজন বিশেষজ্ঞ অন্য বিশেষজ্ঞের কাছেও রোগী পাঠান।
এমনকি এক হাসপাতাল অন্য হাসপাতালেও রোগী পাঠায়। সব জায়গায় এ পদ্ধতি চালু হলে দরিদ্র রোগীদের আর্থিক সাশ্রয় হবে। এক স্তর থেকে অন্য স্তরে রোগী পাঠানোর সুযোগ তৈরি হবে। তবে যে রোগীকে উন্নততর হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে, সেখানে তার জন্য ফোকাল পয়েন্ট বা দায়িত্ববান ব্যক্তিকে তা সুনির্দিষ্ট হতে হবে। তা না হলে সে গুরুত্ব পাবে না।
তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে রেফারেল ব্যবস্থা কার্যকর করা সম্ভব।
ভোরের আকাশ/নি