logo
আপডেট : ৬ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৪:০৩
ভুমিকম্পের উৎপত্তিস্থল সাগরতল
বড় ধরনের সুনামির ইঙ্গিত
শাহীন রহমান

বড় ধরনের সুনামির ইঙ্গিত

শাহীন রহমান: সকাল ৯টা ২ মিনিট, সোমবার। ৫.২ মাত্রার ভ‚মিকম্পে কেঁপে ওঠে দেশের বিভিন্ন এলাকা। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল বঙ্গোপসাগরের তলদেশ। সাগরতলদেশ থেকে ভ‚মিকম্পের উৎপত্তি কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে?

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অস্বাভাবিক না হলে বঙ্গোপসাগরের তলদেশ থেকে ভ‚মিকম্পের উৎপত্তি খুব একটা দেখা যায় না। তবে সাগরতলে বড় ধরনের ভ‚মিকম্প হলে সুনামির আশঙ্কা থাকে।

 

গতকাল ভূমিকম্পে সুনামির সতর্কতা ছিল না। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের ভ‚মিকম্পের কারণে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সুনামিক আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, ভূমিকম্পের উৎসস্থল থেকে ঢাকার দূরত্ব ৫২৯ কিলোমিটার।

 

কক্সবাজার থেকে ৩৪১ কিলোমিটার। টেকনাফ এবং বরিশাল থেকে যথাক্রমে ৩১৯ এবং ৩৪৯ কিলোমিটার। মার্কিন ভ‚তাত্তি¡ক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) বলছে, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল বঙ্গোপসাগর। এর উৎপত্তিস্থল বঙ্গোপসাগরে এর গভীরতা ছিল ১০ কিলোমিটার।

 

ভূমিকম্প নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ‚তত্ত¡ বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ন আকতার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অবজারভেটরি কেন্দ্রেরও প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি।

 

তিনি বলেন, দেশের উপক‚লীয় এলাকা ঘিরেই ভয়াবহ সুনামি সৃষ্টির জন্য সাইসমিক গ্যাপ বিরাজমান রয়েছে। এ গ্যাপ থেকে যে কোনো সময় সুনামি হতে পারে। বঙ্গোপসাগরের উত্তরে আন্দামান থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাবডাকশন জোন বরাবর ৬০০ কিলোমিটারের একটি সাইসমিক গ্যাপ রয়েছে।

 

এখানে কোনো ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার রেকর্ড নেই। বর্তমানে শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার জন্য যথেষ্ট শক্তি এই সাইসমিক গ্যাপে জমা হয়ে আছে। এই সাইসমিক গ্যাপ আমাদের জন্য অশনিসংকেত। এখান থেকে ৮ মাত্রার মতো শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর তা যদি সাগরতলে হয়, তাহলে সেই ভ‚মিকম্প সুনামি সৃষ্টি করতে পারে।

 

টেকনাফ-আন্দামান সাইসমিক গ্যাপ থেকে দেশের উপক‚লের দূরত্ব মাত্র ৭৫০ কি মি.। আর এখান থেকে সুনামি হলে দেশের উপক‚লে সুনামির ঢেউ আসতে মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় নেবে। তাই কিছু বোঝার আগেই বঙ্গোপসাগরে আমাদের উপকূলের জনপদ বিলীন হয়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।

 

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই দেশে সুনামি ও ভ‚মিকম্পের ঝুঁকি বেশি। কারণ তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। বঙ্গোপসাগরের মাথা ঘেঁষে বেঙ্গল বেসিনের প্রধান অংশেই বাংলাদেশের অবস্থান।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাগর বা বড় হ্রদে খাড়াভাবে পানির আকস্মিক স্থানচ্যুতি হলে যে ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়, তাকে সুনামি বলে। পানির মধ্যে এ ধরনের স্থানচ্যুতি ভুমিধসের কারণে হতে পারে। মহাকাশ থেকে উল্কাপিন্ড সাগর বা হ্রদে অথবা বৃহৎ জলরাশিতে পড়লে পানির স্থানচ্যুতি হতে পারে।

 

আবার সাগরতলে ভূমিকম্প হলেও পানির স্থানচ্যুতি হতে পারে। সৈয়দ হুমায়ন আকতার বলেন, সাগরের সব ভূমিকম্প সুনামি সৃষ্টি করে না। যে ভূমিকম্প সাগরতলকে খাড়াভাবে হঠাৎ কয়েক মিটার ওপর বা নিচের দিকে স্থানচ্যুতি ঘটাবে সেই ভূমিকম্পই কেবল সুনামি সৃষ্টি করবে। তবে স্থানচ্যুতি আনুভ‚মিক হলে ভূমিকম্প ৯ মাত্রার হলেও তখন সুনামি হবে না। কারণ আনুভূমিক ভ‚-আলোড়নে সমুদ্রতল খাড়াভাবে ওপর-নিচে স্থানচ্যুতি ঘটবে না।

 

তিনি বলেন, গভীর সমুদ্রে সুনামির ঢেউয়ের গতিবেগ থাকে তীব্র। ঘণ্টায় ৫০০ থেকে ৭০০ কি মি.। ঢেউয়ের উচ্চতা থাকে ১ মিটারের নিচে। তীরে আসতে আসতে এই ঢেউয়ের গতি কমে যায় কিন্তু শক্তি না হারিয়ে ঢেউয়ের উচ্চতা ৫-৩০ মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। ভূমি অপেক্ষাকৃত যত নিচু হবে সুনামির ঢেউরাশি ভ‚মির অনেক ভেতরে বিপর্যয়কর আঘাত হানতে সক্ষম হবে।

 

রেকর্ড বলছে, ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর সাগরে বড় ধরনের ভূমিকম্প থেকে সুনামি সৃষ্টি হয়। সেই সুনামির কারণে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেমিয়াসহ এ অঞ্চলে প্রাণহানি হয়েছিল ২ লাখ ২৫ হাজার। তবে বাংলাদেশ এর আঘাত থেকে রক্ষায় পেয়েছিল।

 

তার কারণে হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাগরতলে ফাটল হয়েছিল উত্তর-দক্ষিণ বরাবর। আর তাই ঢেউয়ের প্রধান গতিপথ ছিল পূর্ব-পশ্চিমে। কিন্তু টেকনাফ-আন্দামান সাইসমিক গ্যাপের প্রত্যাশিত ফাটল উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে হওয়ায় সুনামির ঢেউয়ের প্রধান গতিপথ থাকবে উত্তর-পশ্চিম বরাবর।

 

ফলে বঙ্গোপসাগরে সুনামি সৃষ্টি হলে তা ভারতের উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, কক্সবাজার, স›দ্বীপসহ উপক‚লের সব অঞ্চলে সরাসরি আঘাত হানবে। দেশের সমতল ভ‚মি অত্যন্ত নিচু এলাকা হওয়ায় এই সুনামির প্রভাব অনেক ভেতরে চলে আসবে। টেকনাফ-আন্দামান সাইসমিক গ্যাপ থেকে আমাদের উপক‚ল মাত্র ৭৫০ কি মি.। আমাদের উপক‚লে সুনামির ঢেউ আসতে মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় নেবে। তাই কিছু বোঝার আগেই বঙ্গোপসাগরে আমাদের উপক‚লের জনপদ বিলীন হয়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়ে যাচ্ছে।

 

তারা বলছেন, ইতিহাসে এ উপমহাদেশে সুনামির প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় আরব সাগরে ভারতের পশ্চিম উপক‚লে কুচ অঞ্চলে খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬-এ। আরও ৩টি সুনামি ১৫২৪, ১৮১৯ ও ১৯৪৫ সালে ভারতের পশ্চিম উপক‚লে বিপর্যয় ঘটিয়েছে। বঙ্গোপসাগরে প্রথম সুনামির রেকর্ড ১৭৬২ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম উপক‚লে।

 

এই সুনামিতে আমাদের উপক‚লে প্রাণহানির প্রমাণ না থাকলেও ওই সময়ে ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকাডুবে ৫০০ জনের প্রাণহানি হয়েছিল। বঙ্গোপসাগরে আরো ২টি সুনামি ১৮৪৭ ও ১৮৮৩ সালে নিকোবার দ্বীপ ও মাদ্রাজে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে। সর্বশেষ ২০০৪-এর এশিয়া সুনামি বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এশিয়া সুনামির নিষ্ঠুরতা বঙ্গোপসাগরেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সুদূর আফ্রিকার মাদাগাসকার ও সোমালিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে উল্লেখ করেন।

 

বঙ্গোপসাগরের সৃষ্ট এই ভ‚মিকম্প স্বাভাবিক কিনা বা এর ফলে ভবিষ্যতে কোনো সময় সুনামির আশঙ্কা আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক মো. জিল্লুর রহমান বলেন, গত ১০০ বছরের ভ‚মিকম্পের ইতিহাস যদি দেখি, তবে উৎপত্তিস্থল হিসেবে বঙ্গোপসাগরের এই জায়গাকে একেবারে নতুন বলা যায় না। এখানে এর আগেও ভ‚মিকম্পের উৎপত্তি হয়েছে।

 

সর্বশেষ ১৯৯৯ সালে ভ‚মিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল এই স্থান। জিল্লুর রহমান আরো বলেন, যে ভ‚মিকম্প হয়েছে এর ব্যাপ্তি ছিল মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরে। আর এই স্থান থেকে সুনামি সৃষ্টির আশঙ্কা নেই বললেই চলে।

 

কারণ, এটি টেকটোনিক বাউন্ডারি বা ভ‚তত্ত¡ক সীমার বাইরে। এখানে ছোটখাটো কিছু চ্যুতি বা ক্রাস্টাল ফল্ট আছে। যেখান থেকে ছোট মাত্রার ভ‚মিকম্প হয়। এটা একাধিকবার হয়েছে। আগের অভিজ্ঞতা বলে এখান থেকে সুনামি হয় না।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়। অন্যসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো এর আগাম আভাস দেয়া এখনো সম্ভব নয়। এ বিষয়ে অনেক গবেষণা চলছে। ভ‚মিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমানো যায়, যদি জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যায়। এ ব্যাপারে সরকার, এনজিও, গণমাধ্যম কার্যকর ভ‚মিকা রাখতে পারে।

 

ভোরের আকাশ/নি