logo
আপডেট : ৭ ডিসেম্বর, ২০২২ ১২:৩৩
বিশ্বকাপের অতিথি এশিয়া ও আফ্রিকা
শামীম হাসান

বিশ্বকাপের অতিথি এশিয়া ও আফ্রিকা

শামীম হাসান: বিশ্বকাপ ফুটবলে একচ্ছত্র আধিপত্য ইউরোপ এবং দক্ষিণ আমেরিকার। সেখানে বিশ্বকাপের শুরু থেকে এ পর্যন্ত এশিয়া ও আফ্রিকা অনেকটা অতিথির মতোই হয়ে আছে। অনেকটা অংশগ্রহণই যেন বড়কথা। কখনো কখনো প্রথম রাউন্ডের বাধা পার হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে পৌঁছানোই যেন সার্থকতা। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি।

 

দ্বিতীয় রাউন্ড পার হওয়ার ঘটনা ঘটেছে কালেভদ্রে। যেমন ২০০২ সালে এশিয়া থেকে একটা দল সেমিফাইনালে খেলেছিল। কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে দুবার। একবার উত্তর কোরিয়া (১৯৬৬), অন্যবার দক্ষিণ কোরিয়া (২০০২)। আফ্রিকা থেকে কখনো সেমিফাইনাল খেলার ঘটনা ঘটেনি। এ অঞ্চল থেকে তিনবার কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে ক্যামেরুন (১৯৯০), সেনেগাল (২০০২) ও ঘানা (২০১০)।

 

১৯৩০ সালের প্রথম বিশ্বকাপে ১৬টি দেশ অংশ নেয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ১৩টি দেশ অংশ নেয়। এশিয়া থেকে জাপান এবং আফ্রিকা থেকে মিশরের প্রতিদ্ব›িদ্বতা করতে চাইলেও তারা টুর্নামেন্ট থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৩৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বকাপে ১৬টি দেশ অংশ নেয়।

 

ইতালিতে অনুষ্ঠিত এ আসরে আফ্রিকা থেকে মিশর অংশ নিলেও এশিয়া থেকে কোনো প্রতিনিধি ছিল না। বিশ্বকাপের তৃতীয় আসর ১৫ দল নিয়ে শুরু হয়। অস্ট্রিয়া নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। এ আসরে আফ্রিকার প্রতিনিধি অনুপস্থিত ছিল। তবে এশিয়া থেকে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ নামে একটা দল অংশ নেয়।

 

মূলত ১৯৮২ সালের আগ পর্যন্ত বিশ্বকাপে এশিয়া ও আফ্রিকা অঞ্চল থেকে তেমন কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না। এ দুই অঞ্চল থেকে কখনো একটা আবার কখনো কোনো দলই প্রতিনিধিত্ব করেনি। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে থেকে আফ্রিকা ও এশিয়া অঞ্চলের নিয়মিত উপস্থিতি শুরু হয়।

 

১৯৮২ সালে আফ্রিকা থেকে দুটি এবং এশিয়া থেকে একটা দেশ অংশ নেয়। আফ্রিকা থেকে ক্যামেরুন ও আলজেরিয়া এবং এশিয়া থেকে কুয়েত প্রতিনিধিত্ব করেছিল। তিনটি দেশের কোনো দলই গ্রæপ পর্ব পার হতে পারেনি। তবে আফ্রিকার দুই দেশ দারুণ প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেছিল। দুর্ভাগ্য তাদের। ক্যামেরুন অপরাজিত থেকে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিল। আর আলজেরিয়া জোড়া জয় পেয়েও নকআউট পর্বের টিকিট পায়নি। দুটি দলই গোল পার্থক্যে বাদ পড়েছিল। এশিয়ার দেশে কুয়েতের অর্জন ছিল একটা ড্র।

 

১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে উভয় মহাদেশ থেকে দুটি করে দল অংশ নেয়ার সুযোগ পায়। এশিয়া থেকে ইরাক ও দক্ষিণ কোরিয়া। আর আফ্রিকার প্রতিনিধিত্ব করেছিল আলজেরিয়া ও মরক্কো। এশিয়ার দুই দলের অবস্থা ছিল বেশ নাজুক। দক্ষিণ কোরিয়া এক ম্যাচে ড্র করেছিল আর ইরাক তিন ম্যাচেই হেরেছিল। আলজেরিয়াও হতাশ করলেও মরক্কো বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল। ইংল্যান্ড, পোল্যান্ড ও পর্তুগালের মতো তিন ইউরো শক্তির গ্রুপ থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়ে তারা দ্বিতীয় রাউন্ডে পৌঁছেছিল।

 

আফ্রিকা অঞ্চল থেকে প্রথম দল হিসেবে তারা প্রথম রাউন্ডের বাধা পার হওয়ার কৃতিত্ব দেখায়। সে আসরের ফাইনালিস্ট পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বিদায় নিয়েছিল তারা। ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপেও আফ্রিকা ও এশিয়া অঞ্চল থেকে দুটি করে দেশ অংশ নেয়। এশিয়া থেকে চ‚ড়ান্ত পর্বে খেলার সুযোগ পেয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া ও আরব আমিরাত। আর আফ্রিকার প্রতিনিধি ছিল মিশর ও ক্যামেরুন।

 

প্রথম তিনটি দল সমর্থকদের হতাশ করলেও অদম্য সিংহ নামে পরিচিত ক্যামেরুন বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল। সে সময়ের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে তারা বিশ্বকাপের মিশন শুরু করেছিল। শুধু তাই নয়, রুমানিয়াও তাদের শিকারে পরিণত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে তারা নকআউট পর্বে পৌঁছেছিল।

 

দ্বিতীয় রাউন্ডে কলাম্বিয়াকে হারালেও কোয়ার্টার ফাইনালে তারা ইংল্যান্ডের কাছে অতিরিক্ত সময়ের গোলে হেরে গিয়েছিল।

 

১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে ক্যামেরুন যে সাফল্যের পথ রচনা করেছিল ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে সেই ধারা অব্যাহত থাকে। সাফল্যের পুরস্কার হিসেবে বিশ^কাপের এ আসরে আফ্রিকা থেকে তিনটি দেশ ক্যামেরুন, মরক্কো ও নাইজেরিয়া বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায়। এশিয়ার কোটা সেই দুইয়ে স্থির থাকে। সৌদি আরব ও দক্ষিণ কোরিয়া বাছাই পর্বের বাধা উত্তীর্ণ হয়ে চ‚ড়ান্ত পর্বে খেলা নিশ্চিত করে।

 

তবে ক্যামেরুন এবার সমর্থকদের হতাশ করে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেয়। একই অবস্থা হয় মরক্কোর। তবে চমক দেখায় নাইজেরিয়া। বুলগেরিয়া ও গ্রিসকে হারানোর মাঝ দিয়ে গ্রুপ সেরা হয়ে তারা দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত করে।

 

অতিরিক্ত সময়ের গোলে ইতালির কাছে হেরে তারা বিদায় নেয়। অন্যদিকে এশিয়ার দক্ষিণ কোরিয়া হতাশ করলেও সৌদি আরব দারুণ দুই জয় তুলে নেয়। বেলজিয়াম ও মরক্কোকে হারিয়ে নকআউট পর্বে পৌঁছায়। এ রাউন্ডে সুইডেনের কাছে ১-৩ গোলে হেরে বিদায় নেয় তারা।

 

১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে এশিয়া থেকে অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা এক লাফে দ্বিগুণ হয়ে চারটি দল চ‚ড়ান্ত পর্বে খেলার সুযোগ পায়। ইরান, জাপান, সৌদি আরব ও দক্ষিণ কোরিয়া প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার সুযোগ পায়। সংখ্যা বাড়লেও সাফল্যের খাতা ছিল শূন্যের কোটায়। চার দলের মধ্যে শুধু ইরান একটি মাত্র ম্যাচে জয় পেয়েছিল।

 

অন্যদিকে আফ্রিকা থেকে সুযোগ পেয়েছিল ক্যামেরুন, মরক্কো, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও তিউিনিশিয়া। নাইজেরিয়ার সাফল্য ছিল ঈর্ষণীয়। দুই জয় নিয়ে তারা দ্বিতীয় রাউন্ডে পৌঁছালেও সাফল্যগাথা রচনা করতে পারেনি। ডেনমার্কের কাছে হেরে বিদায় নেয় তারা।

 

২০০২ সালে এশিয়ায় আয়োজিত বিশ্বকাপে উভয় মহাদেশ থেকে অংশ নেয়া দলের সংখ্যা আগের মতোই ছিল। যৌথ আয়োজক জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার পাশাপাশি চীন ও সৌদি আরব এশিয়ার প্রতিনিধি ছিল। আফ্রিকার থেকে চ‚ড়ান্ত পর্বে খেলেছিল ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া, সেনেগাল, দক্ষিণ আফ্রিকা ও তিউনিশিয়া।

 

আফ্রিকা অঞ্চল থেকে সেনেগাল চমক দেখায়। ফ্রান্সকে হারিয়ে দেয় তারা। উরুগুয়ে ও ডেনমার্কের সঙ্গে ড্র করে গ্রুপ রানার্সআপ হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠে দলটি। সুইডেনকে হারিয়ে তারা কোয়ার্টার ফাইনালে ফাইনালে পৌঁছে যায়, তবে তুরস্ক তাদের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেয়। এশিয়া থেকে দুই আয়োজক গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠে। রাশিয়া ও তিউনিশিয়াকে হারিয়ে দেয় জাপান। গ্রুপ সেরা হয়ে নকআউট পর্বে যায় তারা।

 

পর্তুগাল ও পোল্যান্ডকে হারিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া গ্রæপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠে। জাপান অবশ্য দ্বিতীয় রাউন্ড পার হতে পারেনি। তবে দক্ষিণ কোরিয়া ইতালিকে হারিয়ে শেষ আটে জায়গা করে নেয়। শেষ আটের লড়াইয়ে স্পেনকে টাইব্রেকারে হারিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া সেমিতে জায়গা করে নিয়েছিল। ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে তারা জার্মানির কাছে হেরে যায়। বিশ্বকাপে এশিয়ার কোনো দলের এটাই সেরা সাফল্য। শুধু এশিয়া নয়, ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার আধিপত্যের মাঝে এশিয়া ও আফ্রিকার এটাই সেরা সাফল্য।

 

২০০৬ বিশ্বকাপে এশিয়া থেকে ইরান, জাপান, সৌদি আরব ও দক্ষিণ কোরিয়া এবং আফ্রিকা থেকে অ্যাঙ্গোলা, ঘানা, আইভরিকোস্ট, টোগো ও তিউিনিশিয়া চ‚ড়ান্ত পর্বে খেললেও ঘানা কিছুটা সাফল্যের দেখা পেয়েছিল। দলটি দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠলে ব্রাজিলের কাছে হেরে বিদায় নেয়।

 

২০১০ বিশ্বকাপে এশিয়া থেকে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এবং আফ্রিকা থেকে ঘানা দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠে। দক্ষিণ কোরিয়া গ্রিসকে এবং জাপান ডেনমার্ককে হারিয়েছিল। এশিয়ার দুই প্রতিনিধি দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বিদায় নিলেও ঘানা যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেলেও উরুগুয়ের কাছে টাইব্রেকারে হেরে যায়।

 

২০১৪ সালের বিশ্বকাপে এশিয়ার জন্য অস্বস্তিকর ছিল। ইরান, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান কোনো জয় ছাড়াই বিশ্বকাপ শেষ করে। অন্যদিকে আফ্রিকা অঞ্চল থেকে নাইজেরিয়া ও আলজেরিয়া দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠে। নাইজেরিয়া ফ্রান্সের কাছে এবং আলজেরিয়া জার্মানির কাছে হেরে বিদায় নেয়।

 

২০১৮ সালটা এশিয়া ও আফ্রিকার জন্য ছিল বেশ অস্বস্তির। দুই মহাদেশ থেকে ৯টি দল অংশ নিলেও শুধু জাপান দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠে। সেনেগাল পোল্যান্ডকে হারিয়েছিল। দক্ষিণ কোরিয়া হারিয়েছিল জার্মানিকে। এ হার জার্মানকে প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় করে দিয়েছিল।

 

সর্বশেষ অর্থাৎ ২০২২ সালের বিশ্বকাপ আগের সব আসরকে ছাপিয়ে গেছে। এবার এশিয়া থেকে ছয়টি এবং আফ্রিকা থেকে পাঁচটি দল চুড়ান্ত পর্বে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার সুযোগ পায়। এশিয়া থেকে জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া এবং আফ্রিকা থেকে মরক্কো ও সেনেগাল দ্বিতীয় রাউন্ডে পৌঁছেছে।

 

বড় বিষয় জাপান জার্মানি ও স্পেনকে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া হারিয়েছে পর্তুগালকে। মরক্কোও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তারা বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষস্থানীয় দল বেলজিয়ামকে হারিয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/নি