আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমান্বয়ে কমছে গমের দাম। দেশে দাম কমার বদলে গমের দাম বাড়ছে। নানা অজুহাতে গমের দাম বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যাপক আমদানি নির্ভরতার সুযোগ নিচ্ছে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। অথচ দাম নিয়ন্ত্রণে ও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে (এনবিআর) গম আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছে। কিন্তু এ শুল্কমুক্তের সুবিধায় ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের সাধারণ মানুষ।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশে সব পণ্যের আমদানি স্বাভাবিক রয়েছে। গম বা অন্য কোনো পণ্যের আমদানিতে কোনো প্রভাব পড়েনি। তাই বাজারে দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তারপরও এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বিভিন্ন অজুহাতে দাম বাড়িয়ে চলেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে গমের অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৮৫ শতাংশই আমদানির মাধ্যমে পুরণ করা হয়।
চাহিদার মাত্র ১৫ শতাংশ গম দেশে উৎপাদন হয়। দেশের আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা আমদানি কমে যাওয়াকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে গমের দাম ক্রমাগত বাড়াচ্ছেন। গত জানুয়ারিতে দেশে প্রতি কেজি আটার দাম ৩৪ টাকা থাকলেও বর্তমানে প্রতি কেজি আটার দাম বেড়ে হয়েছে ৬৩ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে দেশে আটার দাম বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জমা দেয়া একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত মে মাস থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশে গম আমদানির পরিমাণ ৪৯ শতাংশ কমে ১৭ লাখ ২০ হাজার টন দাঁড়িয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে রয়টার্সের বরাত দিয়ে আরো বলা হয়েছে, গত ২৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম এর আগের বছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৪ শতাংশ কমে প্রতি টন ৩৭১ দশমিক ৪৮ ডলারে বিক্রি হয়েছে। গত ১ মাসে গমের দাম ৬ দশমিক ১৩ শতাংশ কমেছে। গত ২৩ অক্টোবর ১ টন গমের দাম ৩৯৫ ডলার ছিল।
অন্যদিকে, এই সময়ের মধ্যে দেশে আটার দাম প্রতি কেজিতে ৯ শতাংশ বেড়ে ৬০ থেকে ৬৩ টাকা হয়েছে। দেশে ক্রমাগত গম ও আটার দামবৃদ্ধি আন্তর্জাতিক বাজারের ধারার বিপরীত বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এদিকে আমদানিকারক ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে আটার দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ডলারের ক্রমাগত দামবৃদ্ধিকে বড় অজুহাত হিসেবে দাড় করিয়েছেন।
ব্যবসায়ীদের দাবি, ডলার সংকটের কারণে গম আমদানিতে ব্যাংকগুলোর অর্থায়নে অনীহা এবং ভারতের গম রপ্তানি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তও দাম বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ। আমদানিকারক ও প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক বিশ্ব জিৎ সাহা জানান, বর্তমানে বাজারে যে আটা পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোর জন্য গম আগের বাড়তি দামে আমদানি করা হয়েছিল, ফলে বাজারে আটার দাম কমছে না।
আন্তর্জাতিকবাজারে গমের দাম বর্তমানে নিন্ম মুখী স্বীকার করে তিনি বলেন, জ¦ালানি ও পরিবহন খরচ বেড়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকট এবং জ¦ালানির দাম বৃদ্ধিতে বিশ্ব ব্যাপী পরিবহন ও আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও গত কয়েক মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম নিন্ম মুখী।
আর এ পরিস্থিতিতে আমদানি খরচ কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও দেশে যে হারে গমের দাম বেড়েছে সেটা অযৌক্তিক। দাম নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে বাজারে অভিযান চালানো হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত ৩০ নভেম্বর ডলারের দাম ২১ শতাংশ বেড়ে ১০৩ টাকা ৬০ পয়সা দাড়ায়। ১ বছর আগে ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক সংস্থ ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশে আটার দাম ১ বছর আগের তুলনায় ৬৮ শতাংশ বেশি।
মোট চাহিদার প্রায় ৮০ ভাগ গম রাশিয়া, ইউক্রেন, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, তাঞ্জানিয়া, কেনিয়া ও আর্জেন্টিনা থেকে আমদানি হয়। যুদ্ধ শুরুর পর শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে গম আমদানি বন্ধ থাকলেও বর্তমানে তা আবার শুরু হয়েছে। ফলে দেশে গমের বাজারে এতো বেশি হারে দাম বৃদ্ধি হওয়ার কথা নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ব্যাপারে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, বাংলাদেশে পর্যাপ্ত পণ্য মজুত এবং সরবরাহ থাকার পরও ব্যবসায়ীরা ক্রমাগত নানা অজুহাতে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। যা দেশের মানুষকে দুর্ভোগের মধ্যে ফেলছে।
সরকারের যথাযথ বাজার মনিটরিং ব্যবস্থার অভাব এজন্য অনেকাংশে দায়ী। তিনি বলেন, গমসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং আরো জোরদার করা জরুরি। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে গমের চাহিদা ৫৫ লাখ টন। এ চাহিদার বিপরীতে গত বছর দেশে গম উৎপাদন হয়েছে ১২ লাখ টন। গম আমদানির পরিমাণ প্রায় ৫৩ লাখ টন।
বাংলাদেশে যে হারে ধানের উৎপাদন বেড়েছে সে হারে গম উৎপাদন বাড়েনি। প্রতিবছর চাহিদা বাড়লেও সে অনুপাতে বাড়ছে না গমের উৎপাদন। সরকারি খাদ্য গুদামে গত ৯ নভেম্বর পর্যন্ত গমের মজুতের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১৩ হাজার ১৬ টন। এ ছাড়া গত অক্টোবর মাসে রাশিয়া থেকে ৫২ হাজার টন এবং নভেম্বরে ইউক্রেন থেকে আরো ৫২ হাজার টন গম দেশে এসেছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সভাপতি গোলাম রহমান ভোরের আকাশকে জানান, দেশের ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সময় নানা অজুহাতে পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে।
গত কয়েক বছর এ প্রবণতা মাত্রাতিরিক্তহারে বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের মানুষের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে এ অবস্থা নিরসনে সরকারকে কঠোর ভ‚মিকা নিতে হবে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের গম আমদানির বড় অংশ প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে করা হয়। দেশটি গত মে মাসে নিজেদের অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রণে গম রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের বাজারে এবং আটার দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে। এদিকে ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত সরকার দেশে দুই বার ডিজেলের দাম বাড়িয়েছে। ভর্তুকি কমাতে ডিজেলের দাম প্রতি লিটারে ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০৯ টাকা করা হয়েছে। ফলে পরিবহন খরচও অনেক বেড়েছে। এর বিরুপ প্রভাব বিভিন্ন নিত্যপণ্যের বাজারে পড়ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) থেকে চলতি সপ্তাহে বিশ্বের খাদ্যশস্যের উৎপাদন ও আমদানির চিত্র নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
সংস্থাটির হিসাব বলছে, বিশ্বের যেকটি দেশে সবচেয়ে দ্রুত হারে গমের আমদানি বাড়ছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। পাঁচ বছর আগেও গম আমদানিতে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ১০ দেশের তালিকার বাইরে ছিল বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ এ তালিকায় পঞ্চম দেশ।
দেশে পর্যাপ্ত গম আমদানি এবং মজুত থাকার পরও যুদ্ধের অজুহাতে ব্যবসায়ীরা আগেভাগেই দাম বাড়াচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কারসাজি করে, গুজব তৈরি করে যদি দাম বাড়ানো হয়, সেক্ষেত্রে নেয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত সপ্তাহে বাজারে গমের দাম ছিল মণপ্রতি এক হাজার ১২০ টাকা। ২৮ ফেব্রুয়ারী থেকে মণপ্রতি গম বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ২২০ থেকে এক হাজার ২৩০ টাকা। অর্থাৎ এক সপ্তাহের ব্যবধানে গমের দাম বেড়েছে মণপ্রতি ১০০ টাকা।
ভোরের আকাশ/নি