নিখিল মানখিন: সম্প্রতি ঢাকার রূপনগরের আলম মেমোরিয়াল হাসপাতালে হাতের আঙুলে অস্ত্রোপচারের সময় মারা যায় কুড়িগ্রামের ৬ বছর বয়সি শিশু মারুফা জাহান মাইশা। এরপর বেরিয়ে আসে হাসপাতালটি অনুমোদন ছাড়াই চলছিল। নড়েচড়ে বসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
অবৈধ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সতর্কবার্তা জারি করা হয়। সারা দেশে হাজার হাজার অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান সচল রেখে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে অধিদপ্তরের ঘোষণার বিষয়টি আলোচনার ঝড় তুলেছে চিকিৎসক মহলে।
অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করার চিকিৎসকদের দায়িত্ব নয় বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক চিকিৎসক। অথচ অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিতে গিয়ে শিশু মাইশার মতো প্রতিদিন অকালে মৃত্যু ঘটছে অনেক রোগীর। নষ্ট হচ্ছে সময় ও অর্থ। শারীরিক ও মানসিকভাবে হচ্ছেন বিপর্যস্ত।
চলতি বছরের মে মাসের শুরুতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় দেশজুড়ে অবৈধ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করার জন্য অভিযান শুরু করেছিল। কিন্তু তা সফলতার মুখ দেখেনি। শুধু তাই নয়, সারা দেশের মোট অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাই মিডিয়ার সামনে প্রকাশ করতে পারেনি অধিদপ্তর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আলোচনায় নেই অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযান। লোকদেখানো কয়েকদিনের অভিযান চালিয়েই ঝিমিয়ে পড়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে বহুবার নির্দেশনা দিয়েছে অধিদপ্তর। কিন্তু তাদের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে হতাশ হয়েছে দেশবাসী। নির্দেশনা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন সংশ্লিষ্টরা। বছরের পর বছর ধরে অনিবন্ধিত অংসংখ্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমন নির্দেশনার ওপর দেশবাসী আস্থা রাখতে পারছে না বলে আশঙ্কা করেন বিশেষজ্ঞরা। এবার অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেক চিকিৎসক তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে ভোরের আকাশকে বলেন, অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত ও অভিযান চালানোর দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে একজন চিকিৎসক শুধুই একজন কর্মচারী। নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার আগে ও পরে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানটির খুঁটিনাটি কাগজপত্র দেখার সুযোগ পান না চিকিৎসকরা।
মালিকপক্ষ কখনোই চিকিৎসকদের সেই এখতিয়ার দেয় না, দিতে বাধ্য থাকেন না। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেই এখতিয়ার রয়েছে। তারা জানতে চাইলে মালিকপক্ষ তার প্রতিষ্ঠানের সমস্ত কাগজপত্র দেখাতে বাধ্য। তাই এ বিষয়ে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অধিদপ্তরের সতর্কবার্তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে অধিদপ্তরের উচিত অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এমন ক্ষোভ প্রকাশ করেন চিকিৎসকরা। শিশু মারুফা জাহান মাইশার মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে দেয়া অধিদপ্তরের নোটিশে বলা হয়, নিবন্ধনহীন এসব প্রতিষ্ঠানে সেবা দিলে দায়ভার সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে বহন করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিষয়টি জানতে পারলে নিয়মানুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক মাজহারুল হক তপনের সই করা নোটিশে গত মঙ্গলবার এ কথা জানানো হয়।
অধিদপ্তরের নোটিশে বলা হয়, দেশের সব বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে অনলাইন নিবন্ধন ও লাইসেন্স প্রক্রিয়ায় আনার চেষ্টা চলছে। বেশিরভাগ ক্লিনিক, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত। সবগুলোর সেন্টারের ডিসপ্লেতে তাদের লাইসেন্স নম্বর দেখানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, এখনো কিছু বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত না হয়ে অবৈধভাবে চলছে।
তাই সব চিকিৎসককে কোনো হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নিবন্ধন সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে সেবাদানের নির্দেশ দেয়া হলো। এরপরও নিবন্ধনহীন এসব প্রতিষ্ঠানে সেবা দিলে তার দায়ভার সেই চিকিৎসক বহন করবেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ বিষয়ে জানতে পারলে নিয়মানুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা দেশে অলিগলিতে চিকিৎসাসেবার নামে অবাধে অবৈধ ব্যবসা করে যাচ্ছে অসংখ্য অনিবন্ধিত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকে না। বিভিন্ন সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের যোগসাজশ ও লেনদেনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কোথাও কোথাও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন নিয়ে সাজিয়ে বসেছে হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ব্যবসা। ভর্তি করা হয় রোগী। ভাড়া করে আনা হয় চিকিৎসক। মানহীন আইসিইউ সাজিয়ে চালায় রমরমা বাণিজ্য। এমন ফাঁদে পড়ে নানা হয়রানি শিকার হয়ে আসছে অনেক রোগী। সাইনবোর্ডসর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মনীতির বালাই নেই।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আরো জানান, বৈধ-অবৈধ যাচাইয়ের দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। কিন্তু গত কয়েক বছরে অসংখ্যবার উদ্যোগ গ্রহণ করেও সফলতা আসেনি। অথচ দেশজুড়ে জবাবদিহি না থাকায় অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোয় চলে অরাজকতা। থাকে না মানবতার উপস্থিতি।
এসব সেন্টারে হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দ্বারাই চালানো হয় রোগ নির্ণয়ের সব পরীক্ষা। তারা মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করে ঠকাচ্ছে নিরীহ মানুষকে। একই রোগ পরীক্ষায় একেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে একেক রকম রিপোর্ট পাওয়ার অনেক ঘটনা রয়েছে। রোগী মারার কারখানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব সেন্টার থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা চরম বিভ্রান্তিতে পড়েন। নানা সমালোচনার মধ্যেও সরকারি হাসপাতালের একশ্রেণির ডাক্তারদের সহায়তায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের যথেচ্ছ টেস্টবাণিজ্য চলছে বছরের পর বছর। ডায়াগনস্টিক প্রতারণার শিকার মানুষজন। বার বার অভিযোগ তুলেও প্রতিকার পাচ্ছেন না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদন : সরকার সর্বশেষ ২০২০ সালে দেশব্যাপী হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর নিবন্ধন এবং মেয়াদোত্তীর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স নবায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে। বেঁধে দেয়ার সময়ের মধ্যে আবেদন জমাদানকারীদের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকের লাইসেন্স পেতে আবেদন করেননি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে; কিন্তু দিব্যি চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে কয়েক হাজার বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র।
আবার কেউ কেউ লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে চিকিৎসা কার্যক্রম চালাচ্ছে বছরের পর বছর। সব মিলিয়ে প্রায় ১২ হাজার হাসপাতাল-ক্লিনিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া চিকিৎসাসেবার নামে চালিয়ে যাচ্ছে অবৈধ ব্যবসা। দেশে অনুমোদনহীন ১১ হাজার ৯৪০টি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে ২ হাজার ৯১৬টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক লাইসেন্সের জন্য কোনো আবেদনই করেনি।
৯ হাজার ২৪টি হাসপাতাল-ক্লিনিকের মধ্যে বেশিরভাগ লাইসেন্সের জন্য আবেদনের পর অনুমোদন ছাড়াই চিকিৎসা শুরু করেছে। অনুমোদনহীন যেসব চিকিৎসাসেবাকেন্দ্র চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে ৩ হাজার ৫৩৫টি ঢাকা বিভাগে, ২ হাজার ২৩২টি চট্টগ্রাম বিভাগে, ১ হাজার ৫২৩টি খুলনা বিভাগে, ১ হাজার ৪৩৮টি রাজশাহী বিভাগে, ১ হাজার ৯৯টি রংপুর বিভাগে, ৯৬৩টি ময়মনসিংহ বিভাগে, ৬০৩টি বরিশাল বিভাগে এবং ৫৪৬টি সিলেট বিভাগে।
অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার উচ্ছেদকরণে সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যালস কাউন্সিলের সাবেক সভাপতি, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান চিহ্নিতকরণের দায়িত্ব চিকিৎসকদের নয়, অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্টদের।
অধিদপ্তরের উচিত সারা দেশে অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে অভিযান জোরালো করা। অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা শত শত, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার দেশের স্বাস্থ্যসেবার জন্য চরম হুমকি। ওইসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনৈতিক কাজ সম্পাদনের অভিযোগও পাওয়া যায়।
তিনি আরো বলেন, দেশের ভালো ভালো হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক উঠিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। তবে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোরও উচিত চিকিৎসাসেবার দেয়ার সময় মানবিক দিক বিবেচনা করা। রোগীদের কাছে থেকে চড়া ফি আদায় করা ঠিক হবে না। দেশের ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে খারাপের সংখ্যাই বেশি বলে তিনি মনে করেন।
নির্ধারিত ফি আদায়ের ব্যাপারে অধ্যাপক আ ব ম ফারুক আরো বলেন, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে ফি নির্ধারণ করা উচিত। আর বিভিন্ন ক্লিনিকে সরকারি ডাক্তারের সঙ্গে রোগী পাচারের প্রথা বন্ধ করার দাবি জানান তিনি।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব ভোরের আকাশকে বলেন, কর্মরত প্রতিষ্ঠানটির খোঁজ খবর নিতে পারেন চিকিৎসকরা। কিন্তু অবৈধতা চিহ্নিত করার সুযোগ তাদের নেই। অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে এ ধরনের নির্দেশনা বহুবার দিয়েছে অধিদপ্তর। কিন্তু তাদের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে হতাশ হয়েছে দেশবাসী। নির্দেশনা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন সংশ্লিষ্টরা।
বছরের পর বছর ধরে অনিবন্ধিত অসংখ্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। দেশের নিরাপদ জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি ভেবে দেশের অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে জানান ডা. রশিদ-ই মাহবুব।
ভোরের আকাশ/নি