মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: একটি নতুন দেশ হবে, একটি নতুন পতাকা হবে, নতুন দেশের মুক্ত বাতাসে পতপত করে উড়বে সে পতাকা। একটি মানচিত্র হবে, সেই মানচিত্রের অধিবাসীরা ধীরে ধীরে সোনার মানুষে পরিণত হবে। এক দিন সেই ভূখণ্ডের মানুষ পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াবে মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে এসে বিষয়টি বুঝতে পেরেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর আল-বদর, আল-শামস বাহিনী। সে কারণে একটি শেষ নীলনকশা তৈরি করে তারা। এ দেশকে মেধাশূন্য করে দিতে হবে! কারণ জাতিকে মেধাশূন্য করতে পারলে অনেক পিছিয়ে যাবে তারা। হাজার বছরের ঘৃণ্য এই পরিকল্পনা ছিল বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা। দেশকে মেধাশূন্য করার সেই ভয়াল দিন আজ।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে পাকিস্তানি বাহিনী যখন বুঝতে শুরু করে তাদের পক্ষে যুদ্ধে বিজয় অর্জন করা আর সম্ভব নয়, তখন তারা বাংলাদেশকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক, শিক্ষাগত দিক থেকে দুর্বল ও পঙ্গু করে দেয়ার পরিকল্পনা করতে থাকে। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আল-শামস বাহিনীর সহায়তায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বাড়ি থেকে তুলে এনে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে।
বলা হয়ে থাকে, হিটলারের গ্যাস চেম্বারের গণহত্যার চেয়েও ভয়ংকর ছিল বর্বর পাকিস্তানিদের হাতে সংঘটিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। কারণ, এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে শুধু কয়েকটি প্রাণ নেয়া হয়নি, পঙ্গু করে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল পুরো একটি জাতিকে। ইতিহাসবিদদের মতে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অন্তিম আঘাত। ইতিহাসের ঘৃণ্য এই পরিকল্পিত গণহত্যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড হিসেবে পরিচিত। এ দিন নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ড. সিরাজুল হক খান, ড. আবুল খায়ের, ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও ড. সন্তোষ ভট্টাচার্যকে। একইভাবে সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেন, সৈয়দ নাজমুল হক, এএনএম গোলাম মুস্তাফা, নাজিম উদ্দিন আহমেদ, সেলিনা পারভীন এবং চিকিৎসক মো. মর্তুজা, মো. ফজলে রাব্বি ও আলিম চৌধুরীসহ আরো অনেককে হত্যা করা হয়।
এসব মেধাবী সন্তানকে বন্দি অবস্থায় বিভিন্ন বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ক্ষতবিক্ষত ও বিকৃত লাশ রায়েরবাজার এবং মিরপুরের বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। দেশের বরেণ্য এই কৃতী সন্তানদের কেউ ছিলেন শিক্ষক, কেউ সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক অথবা পেশাজীবী। তাদের অনেকের লাশ শনাক্ত করা যায়নি, পাওয়া যায়নি বহু লাশ। সেদিন শত শত মানুষ তাদের স্বজনদের খুঁজতে বধ্যভূমিতে গিয়েছিলেন, তারা কেউ লাশ নিয়ে ফিরে এসেছিলেন, কেউ শূন্য হাতে।
বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশার উল্লেখ পাওয়া যায় ফরমান আলীর ডায়েরিতে। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর স্মৃতি কথায়ও উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশার পরিকল্পনার কথা। বইটি লাহোরের জং পাবলিশার্স প্রকাশ করেছে ১৯৯২ সালে, সেখানে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সাফাই গেয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ ছিল যে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাতে ২০০ বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যবস্থা আমি করেছি। আগের সন্ধ্যায় ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী এবং ভারতীয়রা ঢাকা শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। সত্য ঘটনা হচ্ছে, ১৭ ডিসেম্বর সকালে অনেক মৃতদেহ পাওয়া যায়। এর আগে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে, তাই এই হত্যাকাণ্ড নিশ্চয় তারা ছাড়া অন্য কেউ করেছে।’
এদিকে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৮ জন বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগের প্রতিটি ঘটনায় তখনকার আল-বদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় এবং পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারে প্রমাণিতও হয়। ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর এ রায় ঘোষণা হয়। প্রসিকিউশনের আনা ১১টি অভিযোগের সবগুলোই প্রমাণিত হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর তখনকার সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের এ দুই কেন্দ্রীয় নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ে বলা হয়, ‘আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীন মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৮ জন বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত ছিল।’
অন্যদিকে স্বাধীনতার পরও দেশকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা চলতে থাকে। যার জের ধরে প্রাণ দিতে হয় দেশের আর এক মেধাবী সন্তান জহির রায়হানকে। ১৯৭২ সালের জানুয়ারির ৩০ তারিখে চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান একটি ফোনকল পান। তাকে বলা হয় তার ভাই শহীদুল্লা কায়সার মিরপুরে বন্দি আছেন, তিনি গেলে ভাই ছাড়া পাবেন।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে বুদ্ধিজীবী নিধনের অংশ হিসেবে লেখক-সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাই ফোনকল পেয়ে জহির রায়হান নিখোঁজ ভাইকে ফিরে পাওয়ার আশায় মিরপুরে যান। তারপর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। জাতির জন্য দুঃখজনক যে, বিজয়ের পরও দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রকার মাত্র ৩৭ বছর বয়সে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশার শিকার হন। জহির রায়হান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ‘স্টপ জেনোসাইড’ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি সৃষ্টি করেন, যা বাংলাদেশের গণহত্যার স্বরূপ বিশ্ববাসীর কাছে উন্মুক্ত করে। চলচ্চিত্রটির প্রতিটি মুহূর্তে মিশে আছে জাতির অসীম ত্যাগের ইতিহাস। এই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পান্না কায়সার আবেগতাড়িত হয়ে ভোরের আকাশকে বলেন, ভাইকে খুব ভালোবাসত জহির রায়হান। খবর পেয়ে কিচ্ছু না ভেবে ভাইকে উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার আর ফেরা হয়নি। ভাই নিখোঁজ হওয়ার পর সে আর আমার সামনে আসত না। ভাইকে আনতে গিয়ে নিজেই আর ফিরল না। এর চেয়ে কষ্টের স্মৃতি আর কী হতে পারে!
এদিকে স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন বুদ্ধিজীবী হত্যার সঠিক তালিকা তৈরি হয়নি। বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ শিক্ষাবিদ, ১৩ সাংবাদিক, ৪৯ চিকিৎসক, ৪২ আইনজীবী এবং ১৬ শিল্পী, সাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। ঘাতকরা কেবল ঢাকায় নয়, সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণ মানুষকে নৃশংসভাবে খুন করেছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তথ্যানুযায়ী, এ পর্যন্ত সারা দেশে ৪৬৭টি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। কেবল ঢাকা ও এর আশপাশে ৪৭টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়েছে। যেখানে দখলদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।
ভোরের আকাশ/আসা