নিত্যানন্দ হালদার, মাদারীপুর: মাদারীপুর জেলায় অসংখ্য বদ্ধভূমি রয়েছে। এ সকল বদ্ধভূমির মধ্যে ১৫টি বদ্ধভূমি উলে¬খযোগ্য। এ সকল বদ্ধভূমি সংরক্ষণের অভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। এদিকে বদ্ধভূমি সংরক্ষণ ও মাদারীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের পাশে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে বীর শহীদদের নামের তালিকা টানানো না হওয়ায় বীর মুক্তিযোদ্ধারের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা মাদারীপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে নির্বিচারে গণহত্যা, গ্রামের পর গ্রাম অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারী নির্যাতন চালিয়ে মানবতাকে স্তম্ভিত করে দেয়। শহরে গ্রামে গণহত্যা চালিয়ে লাশগুলো ফেলে চলে যায়। পরে এলাকাবাসী তাদের স্বজনদের লাশ গর্ত খুঁড়ে মাটিচাপা দিয়ে রাখে।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এসব কথা জানান ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এই অঞ্চলের ‘খলিল বাহিনী’ প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান খান। তিনি আরো জানান হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও পাক বাহিনীর বর্বরতার কথা। জেলার গণশহীদ পরিবার ও একাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, স্বাধীনতা অর্জনের ৫১বছর পেরিয়ে গেলেও শহীদ স্মৃতি সংরক্ষণের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। সরকারিভাবে ২০১৩ সালে মাদারীপুরের ১০টি বদ্ধভূমির উন্নয়ন ও সংরক্ষণের জন্য কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আজও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বীর মুক্তিযোদ্ধারা আরো বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন (গণহত্যার শিকার বা গণশহীদ) তাদেরকে আজও শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, ৫১ বছরে তাদের পরিবার অবহেলিত এবং অবহেলিত তাদের কবরগুলো।
সরেজমিন অনুসন্ধান করে জানা গেছে, মাদারীপুর সদর উপজেলায় ৭টি এবং রাজৈর উপজেলায় ৮টি বদ্ধভূমি রয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার কুকরাইল মৌজার এ আর হাওলাদার জুট মিলের অভ্যন্তরে জেলার সর্ববৃহৎ বধ্যভূমি। এখানে প্রায় ৭৫০শত মুক্তিকামী নর-নারী ও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নির্মমভাবে নির্যাতনের পর হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া হয়। বর্তমানে স্থানটি গো-চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। মিলের ডি-টাইপ বিল্ডিংয়ের টর্চার সেলে অসংখ্য নারীকে মাসের পর মাস আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে শহীদ সুফিয়ার পরিবার অন্যতম। বীর মুক্তিযোদ্ধা ললিত মোহন ভক্ত বলেন, ‘সদর উপজেলার কেন্দুয়া ইউনিয়নের পূর্ব কলাগাছিয়া সুষেন হালদারের বাড়ির পুকুর পাড় বধ্যভূমি। এখানে ৩৫ জন মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া হয়। সদর উপজেলার কেন্দুয়া ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামের তারাপদ শিকারির বাড়ির পুকুর পাড় বধ্যভূমি। এখানে ৬২ জন মুক্তি পাগল মানুষকে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া হয়।
সদর উপজেলার দুধখালী ইউনিয়নের মিঠাপুর শিকদার বাড়ি বধ্যভূমি। বর্তমানে এই বধ্যভূমির ওপরে গড়ে উঠেছে দ্বিতল ভবন, রয়েছে সরকারি ব্যাংক ও অন্য অফিস। এখানে স্মৃতিফলক নির্মাণের বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। সদর উপজেলার দুধখালী ইউনিয়নের মিঠাপুর গোপীঠাকুরের বাড়ির পিছনে পুকুরের উত্তর পাশে বধ্যভূমি। বর্তমানে সেখানে বাঁশঝাড় ও মরিচ-বেগুনের চাষ করা হচ্ছে। উলে¬খিত দুটি বধ্যভূমিতে ৫১ জন মুক্তি পাগল মানুষকে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তথ্য অনুসন্ধান করে ৩৮ জনের নাম পাওয়া গেছে। সদর উপজেলার কেন্দুয়া ইউনিয়নের চৌহদ্দি হাটখোলা বধ্যভূমি। এখানে ৩০ জন মানুষকে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া হয়েছিল। সদর উপজেলার পৌরসভার অধীন কুলপদ্বী সাবেক সরকারি শিশু সদন ভবনের পূর্ব পাশে বধ্যভূমি, যেখানে দোলযাত্রার ভাঙা মঠ রয়েছে। এখানে ১৬ জন মুক্তিপাগল মানুষকে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া হয়। কুলপদ্মী জেলেপাড়া বদ্ধভূমিতে ১১জন শহীদের লাশ রয়েছে। রাজৈর থানার সেনদিয়ার শহীদ পরিবারের সদস্য প্রভাষ বাড়ৈ ও শহীদ পরিবারের সদস্য শচীন বারিকদার বলেন, বাজিতপুর ইউনিয়নের কমলাপুর গ্রামের কেষ্ট বৈদ্যর বাড়ির পুকুর পাড় একটি গণকবর রয়েছে। এখানে প্রায় ৭০ জন মুক্তি পাগল মানুষকে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া হয়।
রাজৈর উপজেলার আমগ্রাম ইউনিয়নের পাখুল¬া গ্রামের রাসু গাটিয়ার বাড়ির পুকুর পাড় বধ্যভূমি। এখানে প্রায় ৩০ জনকে মানুষকে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া হয়। রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ি ইউনিয়নের গণেশ পাগলের সেবা আশ্রমের পূর্ব পাশে, যেখানে মেলা অনুষ্ঠিত হয়, সেই পুকুর পাড় বধ্যভূমি। এখানে প্রায় ৭৫ জন মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া হয়। রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের সেনদিয়া গ্রামের আলেক ফকিরের বাঁশঝাড় (বুড়ির ভিটা) সংলগ্ন ৩ খালের সংযোগ স্থানে বধ্যভূমি। রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের সেনদিয়া গ্রামের সিদ্দিক মাতব্বরের বাড়ির দক্ষিণ পূর্ব কোনে বধ্যভূমি। রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের সেনদিয়া গ্রামের শচীন বারিকদারের বাড়ির দক্ষিণ পাশে খালের পাড় (গণেশ বারিকদারের বাড়ির সামনে) বধ্যভূমি। রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের সেনদিয়া গ্রামের ডা. রাসু বারিকদারের বাড়ির পাশে বাগানের ভেতরের খালপাড় দক্ষিণ পূর্ব কোনে বধ্যভূমি। রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের ছাতিয়ানবাড়ি গ্রামের পূর্ণ চন্দ্র বৈদ্য এর বাড়ির উত্তর পাড় পুকুরের মধ্যে বধ্যভূমি। রাজৈর উপজেলার সেনদিয়া ছাতিয়ান বাড়ি ও পলিতা গ্রামের ৬টি বধ্যভূমিতে ১২৭ জন নর-নারীর লাশ রয়েছে।
ভোরের আকাশ/আসা