logo
আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৭:৩৮
বাবা-মাকে খুঁজে পেলেন ৩৫ বছর পর!
জাহাঙ্গীর আলম, ময়মনসিংহ

বাবা-মাকে খুঁজে পেলেন ৩৫ বছর পর!

জাহাঙ্গীর আলম, ময়মনসিংহ: তখন হাসিনার বয়স পাঁচ বছর। পরিবারের শাসন বোঝার তেমন জ্ঞান হয়নি তার। বাবা-মা কটু কথা বললেই মনে কষ্ট গেঁথে রাখত ছোট্ট এই শিশুটি। একদিন কথা না শোনায় সামান্য মারধর করেন মা। এতেই রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান হাসিনা। ঠিকানা মনে করতে না পারায় তখন আর ফিরতে পারেননি। হারিয়ে যান। ধীরে ধীরে নানা ঘটনাপ্রবাহে কেটে যায় দীর্ঘ ৩৫। বাড়ি কিংবা বাবা মাকে খুঁজে পাবেন কি পাবেন না, ছিলো না সেই নিশ্চয়তা। এ যেন এক সিনেমার বাস্তব ঘটনা । দীর্ঘ ৩৫ বছর কেটে যাওয়ার পর অবশেষে পরিবারকে খুঁজে পেলেন তিনি।

 

স্টুডিও অব ক্রিয়েটিভ আর্টস লিমিটেডের ‘আপন ঠিকানা’ নামের ইউটিউব চ্যানেলের অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন জনপ্রিয় আরজে গোলাম কিবরিয়া সরকার। তার উপস্থাপনায় পরিবারের সন্ধান পেয়েছেন হাসিনা। গত সোমবার দুপুরে বাবা খোরশেদ আলম মেয়েকে দেখতে ছুটে যান হাসিনার স্বামীর বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার অরণ্যপাশা গ্রামে। মেয়েকে কাছে পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

 

জানা যায়, হাসিনা প্রায়ই মায়ের বকাঝকা কিংবা মার খেয়ে রাগ করে নিজেদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে দাদুর বাড়িতে গেলেও সেদিন চলে যান সোজা লঞ্চঘাটে। ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার গঙ্গাপুর গ্রামে দাদুর বাড়ির পাশেই ছিল লঞ্চঘাটটি। একপর্যায়ে সেখানকার লঞ্চ তাকে ভেড়ায় রাজধানীর সদরঘাটে। এরপর কীভাবে ফিরবেন বাড়ি, এই ভেবে একটি দোকানের সামনে বসে অঝোরে কাঁদতে থাকেন তিনি।

 

এ সময় হাসিনার কাঁদার দৃশ্য চোখে পড়ে কেরানীগঞ্জের বরিশুর বাজার কালন্দী গ্রামের হাসেম উদ্দিন নামে এক বৃদ্ধের। ঠিকানা বলতে না পারা শিশুটিকে কাছে টেনে নেন হাসেম। পরে তাকে নিয়ে যান বাড়িতে। হাসেম উদ্দিন নিজের সন্তানের মতোই তাকে লালন-পালন করতে থাকেন।

 

১৪ বছর বয়সে ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার গাংগাইল ইউনিয়নের অরণ্যপাশা গ্রামের ফজলুর রহমানের সঙ্গে বিয়ে হয় হাসিনার। বিয়ের পরপরই মারা যায় তাকে লালনপালন করা বাবা-মা। এরই মধ্যে হাসিনা হন চার মেয়ে আর দুই ছেলের জননী।

 

হাসিনা জানান, স্বপ্ন ছিল কোনো এক দিন ফিরে পাবেন নিজের পরিবারকে। সেই স্বপ্নের পথে পা বাড়িয়ে ৯ মাস আগে যান ‘আপন ঠিকানা’ অনুষ্ঠানে। জনপ্রিয় আরজে গোলাম কিবরিয়া সরকারের উপস্থাপনায় সে অনুষ্ঠানে খুলে বলেন হারিয়ে যাওয়ার ‘করুণ’ গল্প। এরপর আশায় দিন গুনতে গুনতে অপেক্ষার প্রহর শেষে সপ্তাহখানেক আগে মেলে তার পরিবারের সন্ধান।

 

হাসিনা আক্তার বলেন, ‘বিয়ের পর অনেকের কাছ থেকেই কটু কথা শুনতে হয়েছে। আমার জন্মের পরিচয় ঠিক নাই’- এমন কথাও কেউ কেউ বলেছে। তখন কষ্ট লাগলেও ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি। তবে সব সময়ই মনে হতো আমার বাবা-মা বেঁচে আছেন এখনো। আমি আমার পরিবার ফিরে পেতে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতাম। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন।

 

তিনি বলেন, আপন ঠিকানা অনুষ্ঠানটি আমার মতো হারিয়ে যাওয়া মানুষদের খুবই আপন। উপস্থাপক আরজে গোলাম কিবরিয়া সরকারের মাধ্যমেই আমার স্বপ্নটা পূরণ হয়েছে। আমি তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।

 

হাসিনার বাবা খোরশেদ আলম বলেন, মেয়েকে হারানোর পর আত্মীয়-স্বজনসহ অনেক জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেছি। মেয়ের জন্য সবসময় দোয়া করেছি। মহান আল্লাহ দোয়া কবুল করেছেন বলেই শেষ বয়সে ফিরে পেয়েছি।
হাসিনার স্বামী ফজলুর রহমান বলেন, আমার সন্তানরা তাদের নানির বাড়িতে বেড়াতে যেতে চাইত। কিন্তু এটি কখনো সম্ভব নয় মনে করেই কষ্ট পেত। এখন সবাইকে নিয়ে আমার শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যাব।

 

এ বিষয়ে আপন ঠিকানার উপস্থাপক আরজে গোলাম কিবরিয়া সরকার জানান, মোবাইলে আপন ঠিকানার ভিডিও দেখে হাসিনা তার বড় মেয়ের কথায় এক দিন ছুটে আসেন স্টুডিওতে। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ভিডিও প্রচার হয়। মেয়ের খোঁজ পাওয়ার পর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ছুটে আসেন খোরশেদ আলম ও তার স্ত্রী মরিয়র আক্তার।

 

পরিচয় নিশ্চিত করতে স্টুডিওতে হাসিনার কাছে প্রথমে আনা হয় মা মরিয়মকে। বিভিন্ন ঘটনা মনে করে তা মেলাতে থাকেন তারা। একপর্যায়ে হাসিনার থুতনিতে থাকা ছোটবেলার একটি কাটা দাগের ঘটনার মাধ্যমেই হাসিনা নিশ্চিত হন এটিই তার পরিবার। পরে বাবা খুরশিদ আলমকে স্টুডিওতে আনা হলে শুরু হয় তিনজনের কথোপকথন। আলাপচারিতায় তিনজনেই ফিরে যান ৩৫ বছর আগে। সেই সঙ্গে ৩৫ বছরে জমা থাকা কথাগুলো বলতে থাকেন তারা।

 

তিনি বলেন, বর্তমানে হাসিনার বয়স ৪০ বছর। এ বয়সে পরিবারকে খুঁজে পেয়ে আবেগাপ্লুত তিনি। এমন সফল পর্বের মাধ্যমে আরো অনেকের পরিবারকে খুঁজে দিতে আমার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

 

ভোরের আকাশ/আসা