ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আবদুল্লাহ: পবিত্র কোরআনের মূল মন্ত্র হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা। তিনি পবিত্র কোরআনে যা করতে হুকুম করেছেন তা পরিপালন করা এবং যা করতে বারণ করেছেন তা না করা এবং তিনি যা ইচ্ছা করেন তাতেই রাজি থাকা।
আল্লাহ এক, অনাদি, অনন্ত, তাঁর কোনো শরিক বা সমকক্ষ নাই। তিনিই সব সৃষ্টি করেছেন, তিনিই সবাইকে পালন করছেন এবং তিনিই সবাইকে সংহার করেন। সন্তান উৎপাদন, সন্তানের জন্ম, পরিবার গঠন, মাতা-পিতার সম্মান, সমাজ গঠন, সমাজ পরিচালনার জন্য সব কার্যাদি, বিয়ে, পর্দা, ব্যভিচারসহ সামাজিক নিরাপত্তা ও দরিদ্রের দারিদ্র্য দূরীকরণ, রাষ্ট্রের নীতিগুলো ইত্যাদি বিষয়ে সুচারুভাবে আলোচনান্তে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা পবিত্র কোরআনে রয়েছে।
মানুষের হক বা অধিকার, হক নষ্ট না করা, মানুষের ন্যায্য পাওনা প্রদান, মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে সর্বদা শান্তি বজায় রাখাসহ সব মানুষ আল্লাহর প্রভুত্ব স্বীকার করা পরস্পর ভাইয়ের মতো মিলেমিশে জীবিকা নির্বাহ ও সমাজ গড়ার নির্দেশনা রয়েছে।
পবিত্র কোরআনে কবীরা ও ছগিরা গুনাহসহ ছোট-বড় সব গুনাহের বর্ণনা দেয়া হয়েছে এবং কোন গুনাহর কোন শাস্তি হবে তাও বলা আছে। আল্লাহ্র সব বিধানই কোরআনে প্রতিফলিত হয়েছে যা অনুসরণ প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য করণীয়। জীবন পরিচালনার জন্য এবং সামাজিক ব্যবস্থায় হারাম ও হালালের বিধান কোরআনে রয়েছে। গুনাহ পরিহারপূর্বক হারাম খাওয়া বা হারাম কাজ করা থেকে বিরত থাকাই মুমিন মুসলমানদের উচিত। নচেৎ এহেন কর্মকান্ডের জন্য জাহান্নামি হতে হবে।
উল্লেখ্য, কবীরা গুনাহ ব্যতীত সব গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দেন যদি আমরা তওবা করি। তওবা করে পুনরায় গুনাহ করলে বা হারাম কাজ করলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। তবে এ কথা বলা যায় যে, আল্লাহ তওবাকারীকে পছন্দ করেন, যখন তওবাকারী তওবা করে সঙ্গে সঙ্গে তিনি ক্ষমা করেন, আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান।
পবিত্র কোরআনের মতে, ইসলামই সৃষ্টির আদি ধর্ম। হযরত আদম (আ.), হযরত দাউদ (আ.), হযরত মুসা (আ.), হযরত ঈসা (আ.) এবং অন্যান্য নবী-রাসুলগণ মুসলমান ছিলেন ও ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। যুগে যুগে মানুষ ইসলামকে বিকৃত করেছে এবং এর অনুশাসন ভুলে গেছে। সে জন্যই আল্লাহ ইসলামকে সঠিকভাবে পুনঃপ্রচার করার জন্য আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে প্রেরণ করেন এবং ওহির মাধ্যমে পবিত্র কোরআন নাজিল করেন।
পূর্বের সব কিতাবের সারমর্ম পবিত্র কোরআনে আছে এবং এটা বর্তমান পরিপূর্ণ ইসলাম ধর্ম। যে ইসলাম কবুল করে, তাঁকে মুসলিম বা মুসলমান (অনুগত) বলা হয়। যুগে যুগে মানুষকে ইসলামের অনুশাসন মতো হেদায়েত (সুপথ প্রদর্শন) করার জন্য প্রত্যেক জাতির কাছেই নবী বা নবীদের আবির্ভাব হয়েছে।
বিশ্বাস (ঈমান) ইসলামের মূল ভিত্তি। আল্লাহর ওপর ঈমান আনার সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে আল্লাহর আদেশ আমল (কার্য) করতে হয়। আমলের মাধ্যমেই আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন, মানুষের প্রতি কর্তৃব্য পালন করা এবং আল্লাহর নির্দেশিত পথে (পবিত্র কোরআন) চলা সম্ভব। এক আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে তাঁর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হবে এবং রমজান মাসে এক মাস রোজা (উপবাস) ব্রত পালন করতে হবে।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের কোনো মাফ নাই এবং নামাজই সব পঙ্কিলতা দূর করে জান্নাতের পথ সুগম করে। যাদের পরিমিত সম্পদ রয়েছে তারা অবশ্যই হজ পালন ও যাকাত আদায় করবে এবং এতে একদিকে যেমন ভ্রাতৃত্ব ভাব সৃষ্টি হবে অন্যদিকে দরিদ্র ব্যক্তিদের দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়ক হবে। ইসলামী রাষ্ট্রে সব মানুষকে সমান অধিকার দেয়ার বিষয়টি পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে। ইসলাম সাম্যবাদী শাসনভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রচলনে বদ্ধপরিকর।
কারণ হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর আমলে মদিনায় প্রথম যে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেটা ছিল আদি ও আদর্শ সাম্যবাদী রাষ্ট্র এবং এ রাষ্ট্রই ইসলামের নীতি ও কোরআনের অনুশাসন পরিপালন করেই পরিচালিত হয়েছিল এবং পরিচালন করা প্রয়োজন।
আল্লাহর পক্ষ থেকে যেসব কাজ ফরজ কিংবা হারাম করা হয়েছে তন্মধ্যে মানুষের বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, যেমন- নামাজ, রোজা, যাকাত, হজ ও চুরি-জেনা ইত্যাদি। পক্ষান্তরে কিছু কাজ মানুষের অন্তরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যেমন : ঈমান ও বিশ্বাস এর যাবতীয় শাখা-প্রশাখা। কুফুরি ও শিরক সর্বাধিক হারাম এবং অবৈধ যেটা আল্লাহ মাফ করবেন না। এগুলোও মানুষের এবং অন্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। উত্তম চরিত্র, যথা বিনয়, ধৈর্য্য, অল্পে তুষ্ট, দানশীলতা ইত্যাদি এবং অপরপক্ষে, কুচরিত্র, যথা অহংকার, হিংসা, শত্রুতা, দুনিয়াপ্রীতি, লোভ, বেপর্দা, জেনা ইত্যাদি অকাট্য হারাম বিষয়গুলোর সম্পর্ক ও মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সঙ্গে নয় এবং অন্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
সব কর্মকান্ডের জন্য কিয়ামতের দিন বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারাহ সর্বাপেক্ষা বড় ও গুরুত্বপূর্ণ সূরা। আল্লাহর বিধি-বিধানের বিরাট অংশ এতে বিধৃত আছে। এ সূরায় গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ও আনুষঙ্গিক এবং ইহলৌকিক ও পারলৌকিক নির্দেশনাবলি যেমন- নামাজ, যাকাত, রোজা, হজ, জিহাদ, পবিত্রতা, তালাক, ইদ্দত, মদ ও সুদের অবৈধতা, ঋণ, লেনদেনের বৈধ ও অবৈধ পন্থা শিশুকে দুগ্ধ পান ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে বর্ণিত আছে।
পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে বলা হয়েছে, ফরজ কাজ করো এবং হারাম কাজ থেকে বিরত থাকো। মানুষের সামনে প্রতারণা করে গা বাঁচানো যায়, কিন্তু আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সর্বজ্ঞানী এবং তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করার কোনো উপায় নেই। তিনি সবই দেখেন, লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর দৃষ্টিতে কোনো কিছু গোপন নেই। ফরজগুলো অবশ্যই পালনীয় এবং প্রতারণার কোনো অবকাশ নেই এবং চিহ্নিত হারাম পরিহার অবশ্যই করণীয়। তাই যা কিছু করব এ প্রত্যয়ের সঙ্গে করব যে সর্বজ্ঞ আল্লাহ বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সব অবস্থাই লিপিবদ্ধ করছেন।
কিয়ামতের দিন সবকিছুর হিসাব দিতে হবে। কোরআন মানুষের মধ্যে এ অনুভ‚তিই সৃষ্টি করে। প্রত্যেক বিধি-নিষেধের শুরুতে কিংবা শেষে খোদাভীতি ও আখেরাতের চিন্তার মতো এমন একটা অনুভ‚তির সৃষ্টি করে দেয়, যা মানুষের অন্তরে অতন্ত্র প্রহরীর মতো কাজ করতে থাকে। তাই বেশি বেশি করে পবিত্র কোরআন বুঝে পড়ি (প্রতিটি আয়াত) এবং এর ব্যাখ্যা স্ব-চিন্তায় করতে থাকি। কোরআন আরবিতে হলেও বর্তমানে বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষায় এর অনুবাদ হয়েছে।
অতি সহজে কোরআন (বাংলায় বা যেকোনো ভাষায়) বুঝে ও হৃদয়ঙ্গম করতে থাকি এবং বারবার পড়তে থাকি। তবেই রাতের আঁধারে, দিনে বা নির্জনেও কোরআনের বিধি-বিধান/নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণপূর্বক পাপ কাজ করতে ভয় আসবে।
মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর নির্দেশিত পথে চলার জন্য এবং এ জন্য যুগে যুগে নবী-পয়গম্বর প্রেরণ করে সমাজ সংস্কার ও ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত করেছেন। সর্বশেষ যে নবীকে প্রেরণ করেছেন তিনি হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তার পরে আর কোনো নবী কিয়ামত পর্যন্ত আসবেন না। আল্লাহ হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে ওহির মাধ্যমে পবিত্র কোরআন নাজিল করেছেন এবং হযরত (সা.) কোরআনের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী চলেছেন, মানব জাতিকে চলতে বলেছেন এবং এ গ্রন্থ ও ধর্মকে প্রচারের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন।
পবিত্র কোরআনে পৃথিবীর প্রতিটি জিনিসই আলোচিত হয়েছে এবং পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের বিধিবিধান দেয়া হয়েছে। শয়তান আল্লাহরই সৃষ্টি এবং এ শয়তানের অনেক ক্ষমতা রয়েছে। শয়তান পৃথিবী সৃষ্টি থেকে কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে এবং মানব জাতিকে আল্লাহ ও রাসুল (সা.)সহ কোরআনের দিকনির্দেশনা অনুসরণ না করার জন্য শয়তান সচেষ্ট আছে। সে জন্য মানবজাতি পাপ করছে এবং শয়তানের কুমন্ত্রণায় আমরা সবাই পবিত্র কোরআনের বিধিবিধান/নির্দেশ ও রাসুল (সা.) এর নির্দেশ পালনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছি এবং অনেকে শয়তানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ইসলাম ও পবিত্র কোরআন অস্বীকার বা পরিচালনা করছি না।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) শিশুকাল থেকেই সত্য কথা বলতেন এবং সততাই ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম গুণ। পবিত্র কোরআনেও বারবার সত্য কথা বলা ও সত্য পথে চলার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যে ব্যক্তি মনেপ্রাণে সত্য বিশ্বাস করে সে অবশ্যই সত্য কথা ও সত্যের পথে চলবে। তার দ্বারা কোনোক্রমেই অসৎ ও হারাম কাজ সংঘটিত হবে না। কাজেই আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে তাঁর কিতাব পবিত্র কোরআনের দিকনির্দেশনা ও রাসুলের (সা.) নির্দেশনা মেনে সত্য কথা বলা ও সৎ পথে চলি। সত্য কথা বলার অভ্যাস ও অসৎ কাজ পরিহার করে সৎ পথে চলে পবিত্র কোরআনের বিধিবিধান পালন সহজতর হবে। যে ব্যক্তি সত্য আমলে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে সে কখনো পাপ কাজে লিপ্ত হতে পারে না।
পবিত্র কোরআনে সালাত কায়েম ও যাকাত আদায় করার বিষয়টি বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। যিনি সম্পদশালী বা যার সম্পদ বছরান্তে উদ্বৃত্ত থাকে তিনি অবশ্যই যাকাত দিবেন এবং তার জন্য যাকাত দেয়া ফরজ। কিন্তু নামাজ পাঁচ ওয়াক্ত আদায় করা সবার জন্য প্রযোজ্য ও পালনীয়। ধনী-দরিদ্র, জ্ঞানী-নিরক্ষর, পুরুষ-মহিলা, উচ্চ বংশ-নি¤œ বংশ সবাই নামাজ পড়তে পারে এবং পড়তে হবে। এ জন্য কোনো অর্থ ব্যয় হয় না, কষ্টও হয় না। নামাজ বেহেশতের চাবি। প্রতিদিন সময়মতো নামাজ আদায় করলে পাপ তাঁকে স্পর্শ করে না।
তবে লোক দেখানো নামাজ অবশ্যই শয়তানের কুমন্ত্রণার ফল। আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে এবং তাঁর সঙ্গে সংযোগ/সম্পর্ক স্থাপনের জন্য নামাজই একমাত্র পন্থা। নামাজ ব্যতীত সহি মুমিন হওয়া যায় না। একাগ্রচিত্তে আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে নামাজ আদায় করলে এবং সৎ পথে চললে অবশ্যই সে পাপ কাজ থেকে অনেক দূরে থাকবে। ফলে জাহান্নাম তাকে স্পর্শ করতে পারবে না ও সে জান্নাতি হবেই।
আমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে, সৎ পথে চলে, সহিভাবে নামাজ আদায় করে আল্লাহর দিদার লাভে সচেষ্ট হই এবং হারাম ও পাপ কাজ থেকে বিরত থাকি। পবিত্র কোরআন বুঝে পড়ে তা অনুধাবন করি, তবেই আমরা জান্নাতি হতে পারব।
লেখক : গবেষক, পরামর্শক ও ইসলামী চিন্তাবিদ
ভোরের আকাশ/নি