নিখিল মানখিন: বছরজুড়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এ বছর দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুুর্ভাব দীর্ঘায়িত হচ্ছে। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরে এসেও অব্যাহত রয়েছে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত। শুধু তাই নয়, ডিসেম্বরেও শনাক্ত হচ্ছে রেকর্ডসংখ্যক রোগী।
এভাবে প্রাদুর্ভাবের সময় ও মৃত্যু সংখ্যার বিবেচনায় দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি গত ২১ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির এমন চিত্র পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, চলতি বছরে জানুয়ারিতে ১২৬, ফেব্রুয়ারীতে ২০, মার্চে ২০, এপ্রিলে ২৩, মে মাসে ১৬৩, জুনে ৭৩৭, জুলাইয়ে ১ হাজার ৫৭১, আগস্টে ৩ হাজার ৫৩১, সেপ্টেম্বরে ৯ হাজার ৯১১, অক্টোবরে ২১ হাজার ৯৩২, নভেম্বরে ১৯ হাজার ৩৩৪ এবং ডিসেম্বরে (১৬ তারিখ পর্যন্ত) ৩ হাজার ৮৬৯ জন ডেঙ্গুজ¦রে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
চলতি বছরে দেশে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ২৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে জুনে ১, জুলাইয়ে ৯, আগস্টে ১১, সেপ্টেম্বরে ৩৪, অক্টোবরে ৮৬, নভেম্বরে ১১৩ এবং ডিসেম্বরে (১৬ তারিখ পর্যন্ত) ১৫ জন মারা গেছেন বলে জানায় অধিদপ্তর। তবে বেসরকারি পরিসংখ্যানে প্রকৃত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আরো বেশি হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিগত কয়েক বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি : ২০১৯ সালে সরকারি হিসেবে ডেঙ্গুতে প্রাণ যায় ১৭৯ জনের। ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন, যা আগের বছর অর্থাৎ ১৮ সালের তুলনায় অন্তত ১০ গুণ বেশি। এরপর বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে ২০২১ সালে। প্রাণ গেছে ১০৫ জনের। ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল এ চার বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে যেসংখ্যক আক্রান্ত হয়েছিল, ২০১৯ সালে তার কয়েকগুণ বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়।
২০২০ সালে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো থাকলেও ২০২১ সালে করোনা মহামারির মধ্যেও ডেঙ্গু পরিস্থিতি বেশ খারাপ হয়। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে যে পরিস্থিতি হয়েছিল, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালেও যদি সেই পরিস্থিতি হয়, তাহলে ২০১৯ সালের ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, ২০২১ সালে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়। ২০২০ সালে মারা যায় সাতজন। ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি মারা যায়, ১৭৯ জন। এর আগের বছর ২০১৮ সালে মারা যায় ২৬ জন।
২০১৮ সালে প্রথম ৫ মাসে ১৩৩ জন আক্রান্ত হয়। এর পরের ৭ মাসে আক্রান্ত হয় ১০ হাজার ১৫ জন। এর মধ্যে জুনে ২৯৫, জুলাইয়ে ৯৪৬, আগস্টে ১ হাজার ৭৯৬, সেপ্টেম্বরে ৩ হাজার ৮৭, অক্টোবরে ২ হাজার ৪০৬, নভেম্বরে ১ হাজার ১৯২ এবং ডিসেম্বরে ২৯৩ জন। মোট আক্রান্ত হয় ১০ হাজার ১৪৮ জন। গত ৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যু হয় ২০১৯ সালে। এ বছর প্রথম ৫ মাসে ৩২৪ জন আক্রান্ত হয়। এপ্রিলে মারা যায় দুজন। এরপর জুন থেকে বাড়তে শুরু করে। পরবর্তী ৭ মাসে আক্রান্ত হয় ১ লাখ ১ হাজার ৩০ জন। এর মধ্যে জুনে ১ হাজার ৮৮৪ জন আক্রান্ত হয়। জুলাই মাসে কয়েকগুণ বেড়ে ১৬ হাজার ২৫৩ জন আক্রান্ত হয়।
এর পরের মাসে আগস্টে জুলাইয়ের তিনগুণ বেড়ে যায়, ৫২ হাজার ৬৩৬ জনের শনাক্ত হয়। সেপ্টেম্বরে আবার কমে আসে, আক্রান্ত হয় ১৬ হাজার ৮৫৬ জন। সেপ্টেম্বরের অর্ধেকে নামে অক্টোবরে, আক্রান্ত হয় ৮ হাজার ১৪৩ জন। নভেম্বরে আক্রান্ত হয় ৪ হাজার ১১ জন। ডিসেম্বরে আক্রান্ত হয় ১ হাজার ২৪৭ জন। এ বছর মোট আক্রান্ত হয় ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। এ বছর সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় আগস্ট মাসে, ৯০ জন। এরপর বেশি মারা যায় জুলাই মাসে, ৪০ জন। সেপ্টেম্বরে ২৭, অক্টোবরে ১১, জুনে ৭ জন, এপ্রিল ও নভেম্বরে ২ জন করে মারা যায়। ২০২০ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় ১ হাজার ২০৬ জন। বেশি আক্রান্ত হয় অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে। অক্টোবরে ১৬৪, নভেম্বরে ৫৪৬ এবং ডিসেম্বরে ২৩১ জন।
২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গুতে কারো মৃত্যু হয়নি। পরবর্তী ৬ মাস জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০৫ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জুলাই মাসে মৃত্যু হয় ১২ জনের, আগস্টে সবচেয়ে বেশি মারা যায়, ৩৪ জন। সেপ্টম্বরে ২৩, অক্টোবরে ২২, নভেম্বরে ৭ ও ডিসেম্বরে ৭ জনের মৃত্যু হয়। ওই বছরে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় ২৮ হাজার ৪৫১ জন। এর মধ্যে প্রথম ৬ মাসে ভর্তি হয় ৩৭২ জন। এর পরের ৬ মাসে ভর্তি হয় ২৮ হাজার ৫৭ জন। এর মধ্যে জুলাইয়ে ২ হাজার ২৮৬, আগস্টে ৭ হাজার ৬৯৮, সেপ্টেম্বরে সবচেয়ে বেশি, ৭ হাজার ৮৪১, অক্টোবরে ৫ হাজার ৪৫৮, নভেম্বরে ৩ হাজার ৫৬৭ এবং ডিসেম্বরে ১ হাজার ২০৭ জন।
এভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র অনুযায়ী, দেশে ২০০০ সালে দেশে সাড়ে ৫ হাজার রোগী ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হন এবং ৯৩ জনের মৃত্যু হয়। ২০০১ সালে আড়াই হাজার লোক ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় এবং ৪৪ জনের মৃত্যু হয়। ২০০২ সালে ৬ হাজার রোগীর মধ্যে ৫৮ জন মারা যান। ২০০৩ সালে ৪৮৬ জনের মধ্যে ১০; ২০০৪ সালে ৪ হাজারের মধ্যে ১৩; ২০০৫ সালে ১ হাজারের মধ্যে ৪ এবং ২০০৬ সালে ২ হাজারের মধ্যে মৃত্যু হয় ১১ জনের।
২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত আড়াই হাজার ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলেও কেউ মারা যাননি।
২০১১ দেড় হাজারের রোগীর মধ্যে ছয়জনের মৃত্যু হয়। ২০১২ সালে ৬৭১ জনের মধ্যে একজন, ২০১৩ সালে প্রায় ২ হাজারের মধ্যে দুই রোগী মারা যান। ২০১৪ সালে ৩৭৫ ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে কেউ মারা যাননি। ২০১৫ সালে ৩ হাজারের মধ্যে ছয়জন, ২০১৬ সালে ৬ হাজারের মধ্যে ১৪ এবং ২০১৭ সালে ৩ হাজারের মধ্যে আটজনের মৃত্যু হয়।
সরকারের রোগতত্ত¡, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মুশতাক হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, দেশে ডেঙ্গু নতুন কোনো রোগ নয়। কিন্তু প্রাদুর্ভাবের সময় এবং মৃত্যু সংখ্যার বিবেচনায় দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি গত ২১ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। তিনি আরো বলেন, বিগত বছরগুলোয় বছরজুড়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়নি। জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হওয়ার খবর পাওয়া যেত। কিন্তু এ বছর ডিসেম্বরে এসেও রেকর্ডসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে, যা আমাদের শঙ্কিত করে তুলেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ব বিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, বিগত বছরগুলোয় ডেঙ্গুর এমন চিত্র দেখা যায়নি। এ বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা ছাড়িয়ে গেছে। নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব থাকার কথা নয়। ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ঘটনাতেও রেকর্ড গড়েছে চলতি বছরের পরিস্থিতি। তাই দেশে বছরজুড়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব থাকার কারণগুলো চিহ্নিত করে তা মোকাবিলার উপায়গুলো বের করতে হবে।
ভোরের আকাশ/নি