নিখিল মানখিন: ফার্মেসিতে নেই প্রকৃত ফার্মাসিস্ট। প্রশিক্ষণহীন লোকজন (ভুয়া ফার্মাসিস্ট) দিয়ে চলছে দেশের ফার্মেসিগুলো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট দিয়ে নিরাপদ ওষুধ সংরক্ষণ, বিক্রি এবং ক্রেতাদের কাছে সঠিক মানের ওষুধ তুলে দেয়া সম্ভব নয়। তাদের কারণে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ হয়ে উঠতে পারে প্রাণনাশের বিষ। এমন ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্টরা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফার্মাসিস্ট ছাড়া ওষুধের দোকান পরিচালনা করা যাবে না বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া নির্দেশনা ফার্মাসি মালিকরা মানছেন না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে দেশের গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা ভিড় জমাচ্ছেন ওষুধ কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে। দেশের ফার্মা প্রোডাক্টের মান ঠিক রাখতে দক্ষ ফার্মাসিস্টের চাহিদা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এছাড়া কসমেটিকস খাতেও গুণাগুণ নিয়ন্ত্রণে ফার্মাসিস্টের প্রয়োজন হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মানুসারে, ফার্মাসিস্টদের ৫৫ শতাংশ কমিউনিটি ফার্মাসি, ৩০ শতাংশ হাসপাতাল ফার্মাসি, ৫ শতাংশ ম্যানুফ্যাকচারিং, ৫ শতাংশ সরকারি সংস্থায় এবং ৫ শতাংশ একাডেমিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে কমিউনিটি কিংবা হাসপাতাল ফার্মাসিতে কোনো গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নেই। অন্যদিকে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে ৮৫ শতাংশ ফার্মাসিস্ট কর্মরত রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক ভোরের আকাশকে জানান, ফার্মাসিস্টদের তত্ত¡াবধানে পরিচালিত ওষুধের দোকানই প্রকৃত ফার্মেসি। একটি ফার্মেসিতে রোগীরা অনেক ধরনের সেবা পাবেন। রোগীর ব্যবস্থাপত্র পরীক্ষা, বয়স অনুযায়ী ওষুধের মাত্রা ঠিকমতো দেয়া হয়েছে কিনা, তা যাচাই, কোন অবস্থায় রোগী ওষুধ খাওয়া চালিয়ে যাবেন এবং কোন ধরনের সমস্যা হলে ওষুধ বন্ধ করে দিতে হবে, সে বিষয়ে পরামর্শ, ব্যবস্থাপত্রে লেখা থাকলেও একটি ওষুধের সঙ্গে অন্যটির কোনো বিরোধ রয়েছে কিনা, তা দেখাসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা ফার্মেসি থেকে পাওয়ার কথা।
আর রোগীদের এসব সেবা দেয়ার জন্য প্রতিটি ফার্মেসিতে থাকা চাই অন্তত একজন ফার্মাসিস্ট। কিন্তু বাংলাদেশে যেসব ফার্মেসি রয়েছে, সেখানে এসব বিষয়ে জ্ঞান রাখে এমন ফার্মাসিস্ট নেই। অর্থাৎ দেশের ওষুধের দোকানগুলোকে ফার্মেসি বলা ঠিক হবে না। কারণ ফার্মেসিতে অবশ্যই একজন ফার্মাসিস্ট থাকবেন। যিনি চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র পর্যবেক্ষণ করে রোগীকে ওষুধ দেবেন। যার থাকবে ওষুধের গুণাগুণ, ব্যবহার, প্রয়োগবিধি, কার্যকর বা ক্ষতি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা।
অধ্যাপক ফারুক আরো জানান, দেশে ফার্মাসিস্ট রয়েছে তিন ক্যাটাগরির। ‘এ’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্টরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মেসি বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। ‘বি’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্টরা চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্সধারী। আর ‘সি’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্টরা তিন মাসের কোর্সধারী, যাদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক পাস। এই ‘সি’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট দিয়ে চলছে ওষুধের দোকান।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ফারুক বলেন, ওষুধের দোকানে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট থাকা জরুরি। কিন্তু এদেশে তা নেই। দেশে ফার্মেসির নামে যেসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা হচ্ছে, সেগুলো মূলত ড্রাগ স্টোর। কারণ বিক্রেতা শুধু ওষুধ বিক্রি থেকে মুনাফাই বোঝেন, ওষুধের সুফল বা কুফল সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই বলে জানান তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে ‘এ’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট রয়েছেন ৬ থেকে ৭ হাজার, ‘বি’ ক্যাটাগরির ৮ থেকে ১০ হাজার ও ‘সি’ ক্যাটাগরির ৭০ থেকে ৮০ হাজার। এদের মধ্যে ‘এ’ ক্যাটাগরির অধিকাংশই ওষুধ কোম্পানি কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বেতনে কর্মরত। আর ‘বি’ ক্যাটাগরির অনেকেই সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত। তবে হাতেগোনা কয়েকজন নিজে দোকান নিয়ে ওষুধের ব্যবসা করছেন।
‘সি’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্টরাও দোকানে থাকছেন না। এ সুযোগে ফার্মেসিতে ঢুকে পড়ছে ভুয়া ফার্মাসিস্টরা। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা ভোরের আকাশকে বলেন, দেশের বিভিন্ন ওষুধের দোকানে ফার্মাসিস্ট রয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত করতে ড্রাগ সুপারদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ড্রাগ সুপাররা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছেন কিনা, তা তদারকির জন্য পরিচালক ও উপপরিচালকদের সমন্বয়ে দায়িত্ব বণ্টন করে দেয়া হয়েছে। দেশের একটি জেলায় মাত্র একজন ড্রাগ সুপার রয়েছেন, যার পক্ষে সব দোকান পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে জেলাগুলোয় ড্রাগ সুপারের পদ বাড়ানোর বিকল্প নেই।
দেশে ফার্মেসির সংখ্যা ও অবস্থা : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশে অনুমোদিত ফার্মেসির সংখ্যা মাত্র ৯৫ হাজার। তার মধ্যে আবার প্রায় ৬০ হাজার ফার্মেসির লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। ওইসব ফার্মেসির মালিকরা গত ২ থেকে ৫ বছর ধরে লাইসেন্স রিনিউ না করে অবৈধভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। দেশে মাত্র ৩৫ হাজার ফার্মেসি বৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। আর অননুমোদিত ফার্মেসির সংখ্যা হবে প্রায় সোয়া ১ লাখ। সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেই এসব ওষুধের দোকান।
ভোরের আকাশ/নি