ইমরান আলী: রাজধানীতে আসছে অবৈধ বিদেশি অস্ত্র। বিশেষ করে রাজশাহীসহ দেশের অন্যান্য সীমান্ত এলাকা দিয়ে অস্ত্রের ছোট-বড় চালান অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। র্যাব-পুলিশের নজরদারির কারণে ধরাও পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, সীমান্তের ওপার থেকে অস্ত্র আনা হচ্ছে। আর এগুলোর গন্তব্যস্থল রাজধানী।
আটকদের জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য মিলছে। তারা বলছেন, অস্ত্র আসার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আর এ কারণে রাজধানীতে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বাস, ট্রেনসহ অন্যান্য যানবহন নজরদারির মধ্যে রেখেছেন। সূত্রে জানা যায়, গত ২৩ ডিসেম্বর রাজশাহীর পুঠিয়া থেকে অস্ত্রসহ দুজনকে আটক করে র্যাব। বিদেশি এ অস্ত্রগুলো রাজশাহীর সীমান্ত দিয়ে আনা হয়েছিল।
র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রেপ্তার আলামিন সীমান্তের ওপার থেকে অস্ত্র নিয়ে এসে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে গত ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ জানতে পারে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত থেকে একটি চক্র বিপুলসংখ্যক অবৈধ বিদেশি অস্ত্র ঢাকায় আনছে। এমন খবরের ভিত্তিতে ডিবির কয়েকটি টিম রাজধানীর গাবতলী এলাকায় গভীর নজরদারি শুরু করে।
একপর্যায়ে রাতে একটি প্রাইভেট গাড়ি তল্লাশি করে। এ সময় ৮টি বিদেশি পিস্তল, ৮ রাউন্ড গুলি, ১৬টি ম্যাগাজিনসহ আকুল হোসেন, ইলিয়াস হোসেন, আব্দুল আজিম, ফারুক হোসেন ও ফজলুর রহমান নামে পাঁচজনকে আটক করে। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, এ চক্র দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র নিয়ে এসে ঢাকায় বিক্রি করে।
২০১৪ সাল থেকে চক্রটি ঢাকায় দুই শতাধিক অস্ত্র বিক্রি করেছে। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর অবশেষে তারা ডিবির জালে আটক হয়। এরপর গত ২২ অক্টোবর শুক্রবার ভোর। রাজশাহী র্যাব-৫-এর কাছে তথ্য আসে বিপুল অস্ত্রের একটি চালান সীমান্তের ওপার থেকে রাজশাহী শহরে প্রবেশ করছে। অস্ত্রগুলো রাজশাহী থেকে ঢাকায় যাবে। এমন খবরের ভিত্তিতে সতর্কাবস্থান নেয় র্যাব। পরে পবা উপজেলার কাটাখালী থানাধীন কাপাশিয়া পাহাড়পুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে।
অভিযানে চারটি বিদেশি রিভলবার, তিনটি বিদেশি পিস্তল, চারটি ম্যাগাজিন, ৮ রাউন্ড তাজা গুলি, ৮টি গুলির খোসা ও বোমা তৈরির বিপুল সরঞ্জাম উদ্ধার করে। একইসঙ্গে আটক করা হয় তিনজনকে। তারা হলেনÑ আতিকুর রহমান ওরফে আতিক, রাজশাহী নগরের চরকাজলা এলাকার মো. শাহীন আলী ও নগরের কাজলার ধরমপুর এলাকার মো. শহিদুল। র্যাব-৫ সূত্র জানায়, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তের ওপার থেকে আসা এটিই অবৈধ অস্ত্রের সবচেয়ে বড় চালান। বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সীমান্তের ওপার থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রগুলো নিয়ে আসা হয়।
সূত্র জানায়, এ দুই এলাকার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র চোরাচালান বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি নওগাঁর নজিপুর, সাপাহার, বদলগাছী জয়পুরহাটের পাঁচবিবি, দিনাজপুরের হিলিসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে আসছে অস্ত্র। চোরাকারবারিরা নানা পন্থায় সীমান্তের ওপার থেকে অস্ত্র নিয়ে এসে রাজধানীর ঢাকার বিভিন্ন সন্ত্রাসীদের হাতে পৌঁছে দিচ্ছে।
রাজশাহী মহানগর পুলিশ ও র্যাব সূত্র জানায়, রাজশাহীসহ আশপাশের যেসব জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছেন এবং অস্ত্র চালানে জড়িতদের গ্রেপ্তার করেছেন তারা সবাই স্বীকার করেছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সীমান্তপথে ভারত থেকে এসব অস্ত্র এসেছে। শিবগঞ্জের শাহবাজপুর, কিরণগঞ্জ, তারাপুর, চৌকা ও বিনোদপুর-খাসেরহাট ও পাকা এলাকা ছাড়াও বালিয়াদীঘি সোনা মসজিদ সীমান্ত অস্ত্র চোরাচালানের মূল রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে আাইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান।
এসব সীমান্তের এপারে গড়ে উঠেছে অস্ত্র চোরাচালানের ২৫টির বেশি সিন্ডিকেট, যারা ভারত থেকে অস্ত্র এনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বড় শহরে চালান করে আসছে। সীমান্তপথে আনা অস্ত্র চাহিদা অনুযায়ী তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিচ্ছে বিভিন্ন দামে। জাপান বা ইউএসএ লেখা থাকলে সেসব অস্ত্রের দাম দ্বিগুণ দামে বিক্রি হয়। রাজশাহী মহানগর পুলিশের একটি সূত্র জানায়, গত ১০ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে কাশিয়াডাঙ্গা মোড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী একতা ট্রান্সপোর্ট নামের একটি যাত্রীবাহী কোচ তল্লাশি করে বশির আহম্মেদ নামের এক যাত্রীর ব্যাগ তল্লাশি করে দুটি অত্যাধুনিক বিদেশি রিভলভার, গুলি ও ম্যাগাজিন উদ্ধার করে মহানগর ডিবি পুলিশ। অস্ত্রবাহক বশির আহম্মেদের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার আটরশিয়া গ্রামে।
তিনি জানান, এসব অস্ত্র ঢাকায় পৌঁছে দিতে বশিরকে ১০ হাজার টাকা দেয়ার কথা হয়েছে। এ মাসুদ আলীর নামে এর আগে শিবগঞ্জ থানায় অস্ত্র মাদক ও বিস্ফোরক আইনে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি রাজশাহীর বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকে পাঁচটি বিদেশি পিস্তলসহ আরো কিছু আগ্নেয়াস্ত্র ও ৫৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেন। এসব অস্ত্র ভারত থেকে সীমান্তপথে আনা তা নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ।
আরএমপির গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার আরেফিন জুয়েল জানান, ভারত থেকে বেনাপোল ও শিবগঞ্জের সীমান্তপথে দেশে আগ্নেয়াস্ত্রের চালান ঢোকে। অস্ত্র চোরাচালানের মূল হোতাদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারেও ডিবি পুলিশ কাজ করছে বলে জানান তিনি।
রাজশাহী র্যাবের অধিনায়ক লে. কর্নেল জিয়াউর রহমান তালুকদার জানান, এ অঞ্চলের অস্ত্র, মাদক চোরাচালান রোধে গডফাদার ও বহনকারীদের পৃথক তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে। চোরাচালানের মূল হোতাদেরও তালিকা হালনাগাদের কাজ চলমান রয়েছে। এতে কার্যকরভাবে সীমান্তপথে আসা মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মশিউর রহমান বলেন, চোরাকারবারী সিন্ডিকেটগুলো নানা কৌশলে সীমান্তের ওপার থেকে অস্ত্রগুলো এনে ঢাকায় নিয়ে আসে। সম্প্রতি বেনাপোল, রাজশাহী, চাঁপাই সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র আনার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।
তিনি বলেন, আমরা সবসময় সজাগ থাকি। বিশেষ করে গত সেপ্টেম্বর মাসে আমরা একটি সিন্ডিকেটকে গ্রেপ্তার করি। এদের গ্রেপ্তারে অনেকদিন সময়ও লেগেছে আমাদের। তিনি বলেন, অস্ত্র চোরাকারবারিদের গ্রেপ্তারে আমাদের একাধিক টিম কাজ করছে। র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডর খন্দকার আল মঈন বলেন, সারা দেশেই র্যাবের ব্যাটালিয়নগুলো অবৈধ অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, আমাদের বেশকিছু অভিযানে গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পেরেছি অস্ত্রগুলো সীমান্তের ওপার থেকেই আসা। এ বিষয়ে আমাদের নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। র্যাব অবৈধ অস্ত্রচোরাকারবারীদের গ্রেপ্তারে সর্বদা চেষ্টাও করে যাচ্ছে।
ভোরের আকাশ/নি