logo
আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৮:১৬
আ.লীগের বিদ্রোহীদের ক্ষমা ঘোষণা, জমা পড়েছে হাজারের বেশি আবেদন
নিখিল মানখিন

আ.লীগের বিদ্রোহীদের ক্ষমা ঘোষণা, জমা পড়েছে হাজারের বেশি আবেদন

নিখিল মানখিন: জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে যারা বিদ্রোহী হয়ে অংশ নিয়েছিলেন তাদের সাধারণ ক্ষমা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। যারা ইতোমধ্যে দলের হাইকমান্ডের ক্ষমা চেয়েছেন, তাদের সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছে। গত ১৭ ডিসেম্বর রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এমন সুযোগ পেয়ে দলীয় হাইকমান্ড বরাবর ক্ষমা চেয়ে আবেদনের হিড়িক পড়েছে। ক্ষমা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে দলীয় নেতাদের মাধ্যমে নানাভাবে তদবির করে যাচ্ছেন অনেকে।

 

দলীয় সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের আমলে দশ ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর আগে দেশের অধিকাংশ পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া বেশ কয়েকটি সংসদীয় আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ইউপি, পৌরসভা ও জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করেছে, করছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। মনোনয়ন বোর্ডের মাধ্যমে দলীয় প্রার্থী মনোনীত করা হয়। তবে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এনে এসব নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি দেখা গেছে। অনেক ইউপিতে শুধু নির্বাচনে অংশ নয়, নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে পরাজিত করে বিদ্রোহী প্রার্থীরা বিজয়ও ছিনিয়ে নিয়েছে। দলীয় ক্ষমা ঘোষণার পর থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক হাজারের বেশি আবেদন জমা পড়েছে বলে জানিয়েছে আওয়ামী লীগের কয়েকটি নির্ভরশীল সূত্র।

 

প্রায় ১৫০০ বিদ্রোহী ইউপি চেয়ারম্যান : দেশে দশটি ধাপে চার হাজার ১৩৬টি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এসব ইউপির মধ্যে ইসি থেকে প্রাপ্ত ৪ হাজার ৪৪টির ফলাফলে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা দুই হাজার ১৯০টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন। এছাড়া এক হাজার ৭৮৯ স্বতন্ত্র প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে ৩৫০ জন বিএনপি সমর্থিত। বাকিদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ সমর্থিত। বিদ্রোহীদের অন্তত এক হাজার ৪০০ জনই আওয়ামী লীগ বা তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী।

 

১৭০ বিদ্রোহী উপজেলা চেয়ারম্যান : দেশে ৪৯২টি উপজেলা পরিষদ আছে। এর মধ্যে ১৬৮ থেকে ১৭০টি উপজেলায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী চেয়ারম্যান হয়েছেন।

 

আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে সারা দেশে যারা বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন, তারা অনেকেই দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। কেউ ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক কিংবা সম্পাদকমণ্ডলীর পদে। আবার কেউ ছিলেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত পদে। দীর্ঘদিন দলের দুঃসময়েও তারা সঙ্গে ছিলেন। দলের কাছে মনোনয়নও চেয়েছিলেন কিন্তু নৌকা তো দেয়া হবে একজনকে। তাহলে বাকিরা কী করবেন। সেক্ষেত্রে দলীয় প্রতীক না পেয়ে অনেকেই রাগ-অভিমান নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীকেই অনেকে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে চিহ্নিত করেন। বিদ্রোহীদের জয়জয়কার হওয়ায় ইতোমধ্যে অনেককেই উপজেলা ও জেলা আওয়ামী লীগ দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি কিংবা বহিষ্কারের সুপারিশ করা হয়। আবার কাউকে কাউকে অব্যাহতি কিংবা পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।

 

দলের সিনিয়র নেতারা আরো বলেন, নির্বাচনে ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহীদের ব্যাপারেও দলের হাইকমান্ড ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করছে। এ নিয়ে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বিভাগীয় সাংগঠনিক দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের কাছ থেকে মাঠ পর্যায়ে দলের অবস্থা কীÑ সে রিপোর্ট নিয়েছেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। এই রিপোর্ট পেয়েই দলের সভাপতি কেন্দ্রীয় নেতাদের বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই দলের সাংগঠনিক অবস্থা জোরদারের কথা বলেন সভানেত্রী। আর যারা বিদ্রোহী ছিলেন তাদের ব্যাপারেও খোঁজখবর নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে নেতারা জানান।

 

বিদ্রোহীদের ক্ষমা : জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে যারা বিদ্রোহী হয়ে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের সাধারণ ক্ষমা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। যারা ইতোমধ্যে দলের হাইকমান্ডের ক্ষমা চেয়েছেন, তাদের সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছে।

 

গত ১৭ ডিসেম্বর রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভায় সভাপতিত্ব করেন।

 

প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সভা শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, জাতীয় কমিটি দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী, দলীয় কোন্দল সৃষ্টিকারী শতাধিক আবেদন গ্রহণ করে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে। দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমা করেছেন। জাতীয় কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে ক্ষমা করেছে। এর বাইরে কেউ থাকলে তারাও আবেদন করতে পারবে।

 

দলীয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের বৈঠকে যারা বিভিন্ন সাংগঠনিক অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে আবেদন করেছেন, তাদের বিষয়টিও তোলা হয়। এদের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল, যারা ইতোমধ্যে দলের হাইকমান্ডের ক্ষমা চেয়েছেন, তাদের সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছে। একই সঙ্গে যারা ক্ষমা চাইবেন তাদের বিষয়টিও বিবেচনায় নেবে আওয়ামী লীগ।

 

দলীয় সূত্র জানায়, বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা করা হলেও তারা দলের স্বপদে ফিরতে পারবেন না। তারা সাধারণ সদস্য হয়ে থাকবেন। তবে ভবিষ্যতে তারা দলের যে কোনো পদ-পদবিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন।

 

আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানায়, সভায় সারা দেশে প্রায় ১৭০ জন বিদ্রোহী উপজেলা চেয়ারম্যানের বিষয়ে আলোচনা হয়। একাধিক নেতা বলেন, বিদ্রোহীরা সবাই আওয়ামী লীগের সক্রিয় নেতা। অনেকে বহু বছর ধরে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করতে কাজ করছেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনে তাদের দলের বাইরে রেখে নৌকার প্রার্থীকে জয়ী করা কঠিন হবে। ফলে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে ক্ষমা করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

 

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ভোরের আকাশকে বলেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সবসময় জাতীয় নির্বাচনের আগে ও শেষ মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ায়, ঐক্যবদ্ধ হয়, গুরুত্ব অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে কখনো ভুল করে না। এবারের যে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হয়েছে, আসলে সেখানে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কেউ ছিলেন না। অন্য কোনো দলের অংশগ্রহণ ছিল না। সে কারণে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাওয়া হয়। এই নির্বাচনে জনগণ অংশগ্রহণ করেছে, যা আমরা সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছি। আবার দলের প্রার্থীর বাইরেও নেতাকর্মীরা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছিল, সেটাতেও আমাদের কঠোর অবস্থান ছিল, শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হয়। সব মিলিয়ে ভালো-মন্দ বিবেচনা করেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই দেশের জন্য, দলের জন্য এবং গণতন্ত্রের জন্য যেটা ভালো, সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

 

আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ড ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ভোরের আকাশকে বলেন, একটা বড়সংখ্যক উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। তারা আমাদের দলেরই মানুষ। দলের জন্য তাদের অনেকেরই ত্যাগ রয়েছে। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তাদের দল থেকে বহিষ্কার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে পাশাপাশি তাদের কাছে সতর্কবার্তাও পৌঁছে দেয়া হয়েছে বলে জানান জাহাঙ্গীর কবির নানক।

 

২০১৯ সালে ক্ষমা পান আড়াই হাজার বিদ্রোহী প্রার্থী : ২০১৯ সালেও বিদ্রোহী প্রার্থীদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করেছিল আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড। ওই বছর শর্তসাপেক্ষে এমন প্রায় আড়াই হাজার ক্ষমা পেয়েছেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন ক্ষমতাসীন দলটির তৎকালীন কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ। তখন তিনি বলেন, প্রায় আড়াই হাজার বিদ্রোহী প্রার্থীকে আমরা মেইল ও চিঠি দিয়ে ক্ষমা করার কথা জানিয়ে দিয়েছি।

 

এই ক্ষমা শর্তসাপেক্ষে জানিয়ে তখন আবদুস সোবহান গোলাপ বলেন, তাদের শেষবারের মতো ক্ষমা করেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভবিষ্যতে সংগঠনবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত হলে তা ক্ষমার অযোগ্য বলে গণ্য করার কথা তাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে। বিদ্রোহীরা ক্ষমা চেয়ে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি দিয়েছিলেন বলে জানান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তারা ভবিষ্যতে সংগঠনের গঠনতন্ত্র, নীতি ও আদর্শ পরিপন্থি কোনো কার্যক্রমে সম্পৃক্ত না হওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। সামনে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন, এই সম্মেলন সামনে রেখে সবাইকে শেষবারের মতো ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন আবদুস সোবহান গোলাপ।

 

ভোরের আকাশ/আসা