logo
আপডেট : ১৭ জানুয়ারি, ২০২৩ ১০:৪৬
বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-বেত শিল্প
বাবুল আহমেদ, মানিকগঞ্জ

বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-বেত শিল্প

মানিকগঞ্জে বাঁশ ও বেতের তৈরি আসবাবপত্র তৈরী করছেন কারিগর।

বাবুল আহমেদ, মানিকগঞ্জ: মানিকগঞ্জসহ সারা দেশে প্রযুক্তির সঙ্গে প্রতিদিনই বদলাচ্ছে মানুষ। আর সেই প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে নিত্যনতুন পণ্যের আবির্ভাবও ঘটছে প্রতিনিয়ত। ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপিÍর পথে ঐতিহ্যবাহী সব দেশীয় শিল্পগুলো। এমনই এক উদাহরণ বাঁশ ও ঐতিহ্যবাহী বেতশিল্প। এক সময় গ্রামীণ জনপদে গৃহস্থালি, কৃষি ও ব্যবসা ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ব্যবহার করা এই শিল্পটি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।

 

আধুনিক এই যুগে মেলামাইন, প্লাস্টিক, লোহা ও প্লেনসিটের সামগ্রীর দাপটে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে বাঁশ ও ঐতিহ্যবাহী এই বেতশিল্প। আর দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো মানিকগঞ্জে বাঁশ ও বেতের তৈরি পণ্যের কদর একেবারে তলানিতে ঠেকেছে।

 

মানিকগঞ্জে একসময় কুলা থেকে শুরু করে বাড়িতে বসার মোড়া, খাট, সোফা সেট, বই রাখার সেল্ফসহ অধিকাংশ আসবাবপত্রই ছিল বেতের। এ ছাড়াও অফিস-আদালত সবখানেই ব্যবহার করা হতো বাঁশ ও বেতের তৈরি আসবাবপত্র। দামে সস্তা ও নাগালের মধ্যে থাকায় বেশ কদরও ছিল এই শিল্পের। এখন সময়ের বিবর্তনে বদলে গেছে চিরচেনা সেই চিত্র।

 

এককালে দেশের বিস্তীর্ণ জনপদে বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি হতো শৌখিন পণ্যসামগ্রী। বাঁশ ঝাড় থেকে তরতাজা বাঁশ-বেত কেটে তৈরি করা হতো হরেকরকমের পণ্য। এসব পণ্য বিক্রি করেই চলত অসখ্য কারিগরের জীবন। এখনো গ্রামীণ উৎসব ও মেলাগুলোতে বাঁশ ও বেতজাত শিল্পীদের তৈরি খাল, চাটাই, খালুই, ধামা, টোনা, পাল্লা, মোড়া, বুক সেল্ফ কিছুটা চোখে পড়ে। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ততই কমছে এই হস্তশিল্পের চাহিদা। একসময় গ্রামীণ মেলাগুলো তালপাখা ছাড়া জমেই উঠত না। সেখানে বর্তমান সময়ে এসব পণ্য পাওয়ার আশা করাটাই ভাগ্যের ব্যাপার।

 

মূল্যবৃদ্ধি, বাঁশ-বেতের দুষ্প্রাপ্যতা আর অন্যদিকে প্লাস্টিক, সিলভার ও মেলামাইন জাতীয় হালকা টেকসই সামগ্রী নাগরিক জীবনে গ্রামীণ হস্তশিল্পের পণ্যকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।

 

বর্তমানে মানিকগঞ্জে বেতের দোকানগুলোয় বিক্রি হচ্ছে মোড়া, বই রাখার তাক, চেয়ার, টি-টেবিল, বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় দোলনা, রকিং চেয়ারসহ শোভাবর্ধক বিভিন্ন সামগ্রী। তবে আগের মতো বাঁশ-বেতের সামগ্রী ব্যবহারের প্রচলন কমে গেলেও মানিকগঞ্জে বেশ কিছু রেস্টুরেন্টে, অফিসের শৌখিন পার্টিশন, সরকারি রেস্ট হাউস ও শৌখিন ধনাঢ্য পরিবারগুলো স্বল্প পরিসরে বেতের আসবাব ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে রকিং চেয়ার, দোলনা, সোফাসেট ও টি-টেবিলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

 

প্রায় ৩০ বছর ধরে এই পেশায় জড়িত থাকা মানিকগঞ্জের জাগীর এলাকার মানিক নামের এক কারিগর জানান, আগে বন-জঙ্গল বেশি ছিল। তাতে বেত চাষ হতো। ফলে দেশের নওগাঁ, দিনাজপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে বেত আনা হতো স্বল্প দামে। তবে এখন এসব অঞ্চলে বেত চাষ কমে যাওয়ায় বিদেশ থেকে বেত কিনে কাজ করতে হয়। আর এতে দাম কয়েকগুণ বাড়লেও তেমন বাড়েনি বেতের তৈরি জিনিসের দাম।

 

তিনি আরো জানান, বর্তমানে ধরনভেদে দোলনা বিক্রি হয় ৮০০ থেকে ৩০০০ টাকায়, বসার মোড়া ৪৫০ থেকে ১৫০০ টাকায়, রকিং চেয়ার ২৫০০, হাই সোফা ২২ হাজার, সোফা সেট ৬ থেকে ২২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এ ছাড়াও খাট ৫ থেকে ৭০ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। চাহিদা কমে যাওয়ায় এই পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন কারিগররাও। সবমিলিয়ে বেত সংকট, কারিগর সংকট এবং বাজারে পণ্যের চাহিদা কম থাকায় ধুকছে এই শিল্পটি। এই শিল্পকে বাঁচানো এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে ।

 

একই এলাকার আরেক কারিগর শফিকুল বলেন, ‘আমাদের এই শহরে বেতশিল্পের দোকান নেই বললেই চলে, প্রথমদিকে কাকার সঙ্গে দোকানে কাজ করতাম। কাকার মৃত্যুর পর থেকে আমি নিজেই দোকানটি সামলাচ্ছি।

 

তিনি আরো বলেন, ‘একসময় বেচাবিক্রি এত বেশি হতো যে, আমি একা দোকানের চাপ সামলাতে হিমশিম খেয়ে যেতাম। কিন্তু বর্তমানে বেচাবিক্রি একেবারে নাই বললেই চলে। ক্রেতার সংখ্যা খুবই কম। বেশিরভাগ সময়ই খালি বসে থাকতে হয়।’

 

দৌলতপুরের মনসুর নামের এক কারিগর বলেন, ‘এক সময় দৌলতপুরে ৬-৭টি দোকান ছিল। কিন্তু বেতের তৈরি জিনিসের চাহিদা কমতে থাকায় অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। এখন মাত্র দুটি বেরাটিসহকারে দোকান রয়েছে।’

 

তিনি আরো বলেন, ‘কয়েক দশক আগে মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হতো এই বেতের আসবাবপত্র। বেত থেকে তৈরি শিশুদের দোলনা, খাট, সোফা, বসার টুল, ফুলদানি, টেবিল, চেয়ার, রকিং চেয়ার, ফুলের ডালিসহ আরো বিভিন্ন আসবাবপত্র শহরের সর্বত্র ছিল নান্দনিক ব্যবহার্য জিনিস। কিন্তু বর্তমানে চাহিদা না থাকায় বেতের এই ব্যবসায়ে কারিগররা জীবন সংগ্রামে টিকিয়ে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে বলে আলম বলেন, ‘একসময় বাসাবাড়িতে ব্যবহার্য জিনিসপত্রের অধিকাংশই ছিল বেতের তৈরি আসবাবপত্র।

 

দোকানে বেতের চেয়ার দেখছিলেন শফিক নামের এক ক্রেতা। তিনি বলেন, ‘আধুনিকতার সঙ্গে মিল রেখে এর সরঞ্জাম ও শৌখিনতায় প্রতিনিয়ত নতুনত্ব আসছে। তবে আমার কাছে এখনো বেতের তৈরি আসবাবপত্রই ভালো লাগে। এজন্যই এখানে কিনতে এসেছি।’

 

ভোরের আকাশ/নি