ইমরান আলী: কেউ নিরুদ্দেশ, কেউ বিদেশে আবার কেউ কারাগারে, তারপরও তাদের কালো থাবা অব্যাহত আছে। একসময় রাজধানী ঢাকা কাঁপানো শীর্ষ ১২ সন্ত্রাসীর খোঁজ না মিললেও তাদের নামেই চলছে চাঁদাবাজি। এমনকি দেশের বাইরে থেকে হত্যার পরিকল্পনা করে সেটি বাস্তবায়নও করছে তারা। আর এ কারণে বছরের পর বছর পার হলেও অদৃশ্য এসব সন্ত্রাসীর প্রভাব কমেনি। তাদের নামে ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী থেকে শুরু করে যার কাছেই ফোন যায়, প্রাণনাশের ভয়ে তারা সেটি মিটিয়েও ফেলে।
তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, বিদেশে অবস্থানরত কিছু সন্ত্রাসীর প্রভাব আছে এটি অস্বীকার করা যায় না। তবে চাঁদার দাবিতে কোথাও থেকে ফোন এলে এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শরণাপন্ন হওয়াই ভালো। এতে করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চিহ্নিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারে।
সূত্রে জানা যায়, আন্ডারওয়ার্ল্ড সন্ত্রাসীদের সর্বশেষ বড় তৎপরতা ছিল মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যা। নিখুঁত পরিকল্পনায় হত্যার ছক এঁকে তা বাস্তবায়ন করে। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ডিবি পুলিশ ও র্যাবের তদন্তে বেরিয়ে আসে হত্যার পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন দুবাইয়ে পলাতক অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান। মূলত জিসানের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে ঢাকায় থাকা তার অনুসারীরা।
এ হত্যাকান্ডের রেশ কাটতে না কাটতে বাড্ডা এলাকায় চাঁদার দাবিতে এক লেদ ব্যবসায়ীকে গুলি করা হয়। চাঁদা না দিলে হত্যা করা হবে এমন ভয় দেখাতেই তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে গুলি করে জিসানের এক অনুসারী। এ ঘটনায় তিনি থানায় জিডি করলে তদন্ত শুরু হয়। ওই তদন্তেও উঠে আসে জিসানের নাম।
সূত্রমতে, গ্রেপ্তারের জন্য পুরস্কার ঘোষণার প্রায় ২০ বছর হলেও এদের সঠিক অবস্থান জানা নেই পুলিশের। অথচ তাদের নাম করে রাজধানীতে ঘটছে ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির ঘটনা। এ ছাড়া তাদের নামে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে গ্রুপ। যারা ওইসব সন্ত্রাসীর নাম ভাঙ্গিয়ে প্রতিদিনই বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।
শীর্ষ এই সন্ত্রাসীদের প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিবির উপকমিশনার মশিউর রহমান বলেন, পুরস্কার ঘোষিত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলকে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীতে তাদের নাম করে চাঁদা চাওয়ার ঘটনাও কম। তবে তারা যেহেতু এদেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী সেহেতু তাদের যেন আইনের আওতায় আনা যায়, সে ব্যাপারে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, বেশ কয়েকটি ঘটনায় পলাতক সন্ত্রাসীদের নাম আমরা পেয়েছি। এসব বিষয়ে আমরা সচেতন। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম করে চাঁদাবাজির জন্য ফোন এলে পুলিশকে জানানোর পরামর্শ এই পুলিশ কর্মকর্তার।
জানা যায়, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করার অভিযোগে দুর্ধর্ষ ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ধরিয়ে দিতে সাড়ে ১৫ লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করে সরকার। এরপর বিভিন্ন সময় ২৩ সন্ত্রাসীর মধ্যে গ্রেপ্তার ও ক্রসফায়ারে মারা যাওয়ার পর এখনো ১২ শীর্ষ সন্ত্রাসী আইনের আওতার বাইরে রয়েছে।
তারা কোন দেশে অবস্থান করছে, সে ব্যাপারেও পুলিশ নিশ্চিত কিছু বলতে পারে না। তবে বিভিন্ন সময় তাদের অবস্থান নিয়ে নানা তথ্য এসেছে পুলিশের কাছে। এ তথ্য সঠিক বলেও মনে করে না পুলিশ। তবে তাদের ব্যাপারে ইন্টারপোলের কাছে তথ্য দিয়ে গ্রেপ্তারের বিষয়ে বলা হয়েছে।
পুলিশ ও র্যাব সূত্রে জানা গেছে, এসব তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীর অনেকে পরে র্যাব-পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর হাতে নিহত বা আটক হয়েছেন। তাদের কেউ কারাভোগ করছেন, আবার কেউ জামিন নিয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। অনেকে আছেন দেশের বাইরে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, এখন তাদের দিন নেই। কিন্তু এখনো তাদের নামে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাস-চাঁদাবাজির খবর পাওয়া যায়। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম ভাঙিয়ে বর্তমানের চাঁদাবাজিকে একধরনের প্রতারণা বললেও একদম অস্বীকার করেননি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
বিভিন্ন সময় প্রাপ্ত অভিযোগ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তালিকাভুক্ত যেসব শীর্ষ সন্ত্রাসী দেশের বাইরে ও কারাবন্দি রয়েছেন, তাদের নামেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চলছে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি। এর মধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী তানভীর ইসলাম জয়, জাহাঙ্গীর ফেরদৌস ওরফে কালা জাহাঙ্গীর ও শাহাদাতের নামে চাঁদাবাজি চলে ‘ক্রাইম জোন’ হিসেবে পরিচিত মিরপুর এলাকায়। পল্লবী এলাকায় এখনো সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি হয় জেল থেকে ছাড়া পাওয়া বিকাশ, কারাবন্দি কিলার আব্বাসের নামে। আর ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুরে চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে অপর শীর্ষ সন্ত্রাসী নবী হোসেনের নাম।
ধানমন্ডি, কলাবাগান, নিউমার্কেট ও হাজারীবাগ এলাকায় রয়েছে ইমন বাহিনীর একছত্র আধিপত্য। পুরান ঢাকার সদরঘাট, পোস্তগোলা, জুরাইন-শ্যামপুর-কদমতলী, কোতোয়ালি, সূত্রাপুর, গুলিস্তান, নবাবপুরে এখনো নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে শীর্ষ সন্ত্রাসী ওমর ফারুক কচি, মুকু ও আলী আজগর বাবুলের নামে। পুরান ঢাকাসহ গোপীবাগ, স্বামীবাগ, ওয়ারী ও করাতিটোলাসহ যাত্রাবাড়ী এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত ডাকাত শহীদ। তিনি ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর তার বিশ্বস্ত অনুসারীরা এখন সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন। নাসির বাহিনীর দাপট কমেনি গোপীবাগে।
সূত্র জানায়, আত্মগোপনে দেশের বাইরে থাকা মোল্লা মাসুদের দখলে তেজগাঁও-মহাখালী এলাকা। এখানে চাঁদাবাজিসহ সব অপকর্মে ব্যবহার হয় তার বাহিনীর নাম। জিসান ও আরমানের নামে রামপুরা, খিলগাঁও ও মগবাজার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে তার সহযোগীরা। মানিক বাহিনী তৎপর রয়েছে রামপুরা, বনশ্রী ও শাহজাহানপুরে।
তবে এসব সন্ত্রাসীর নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা না বলতে পারলেও পুলিশের কাছে থাকা তথ্যে জানা যায়, টোকাই সাগর আমেরিকার নিউইয়র্কে অবস্থান করছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকায় নাম প্রকাশের পরপরই সে পরিবার-পরিজন নিয়ে বিদেশে চলে যায়। সুব্রত বাইনকে নেপাল থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। প্রকাশ কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া সন্ত্রাসীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা সে-ই করে বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে।
এ ছাড়া ইমাম হোসেন ভারতে। জিসান দুবাইয়ে অবস্থান করছে। জয় গ্রেপ্তার হলেও সে বর্তমানে বেরিয়ে ভারতেই অবস্থান করছে। মাঝেমধ্যেই বাংলাদেশ সীমানায় ঢুকে সহযোগীদের সঙ্গে বৈঠক করে আবার চলে যায়। আগা শামীম সুইজারল্যান্ড ও জব্বার মুন্নার অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। কালা জাহাঙ্গীর মারা গেছে বলে জানে তাদের পরিবার। হারিস ভারতে আটক থাকতে পারে বলে পুলিশ বলছে।
এদিকে পলাতক এসব শীর্ষ সন্ত্রাসীর নামে রাজধানীতে এখনো চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির ঘটনা ঘটছে। রাজধানীর পুরান ঢাকা, বংশাল, হাজারীবাগ, মহাখালী, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, কাফরুল, মিরপুর, রামপুরা, মৌচাকসহ আরো বেশ কয়েকটি এলাকায় পলাতক এসব শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম করে বিভিন্ন গ্রুপ উপগ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে। যারা এসব এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, টেন্ডারবাজিসহ নানা অপরাধ করে বেড়াচ্ছে।
র্যাব পুলিশের কর্মকর্তারা বলেন, আমরা বর্তমানে দুই মাধ্যমে তাদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এক. ইন্টারপোলের মাধ্যমে, দুই. নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে। তারা কখন দেশে আসে এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে সোর্স রাখা হয়েছে। ডাকাত শহীদের উদাহরণ টেনে পুলিশের ঊর্ধতন এই কর্মকর্তা বলেন, ডাকাত শহীদ ভারতে পালিয়েছিল। সোর্স এবং গোয়েন্দা ইউনিটের মাধ্যমে তথ্য পাওয়া যায়, সে দেশে এসেছে।
এরপর র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে সে মারা যায়। কর্মকর্তারা বলেন, পলাতক সন্ত্রাসীরা দেশে আসা মাত্রই গ্রেপ্তার করা হবে। এ ছাড়া শীর্ষ এই সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের মাধ্যমে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, বাইরে থাকা সন্ত্রাসীদের আগের মতো প্রভাব আছে বলে আমি মনে করি না। তারপরও আমরা সচেষ্ট। আমাদের গোয়েন্দা ইউনিট কাজ করছে। এখন নতুন করে যারা সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি করছে আমরা তাদের গ্রেপ্তার করছি। আমাদের কার্যক্রম চলমান আছে ।
ভোরের আকাশ/নি