গাজীপুরের টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছে শুক্রবার থেকে। এদিন ভোরে ফরজ নামাজের পর আম বয়ানের মাধ্যমে ইজতেমার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। বেলা ১টা ৫০ মিনিটে অনুষ্ঠিত হয় জুমার নামাজ। নামাজে অংশ নিতে লাখ লাখ মানুষ জড়ো হয়েছিল ইজতেমা মাঠে।
মুল মাঠে জায়গা না পেয়ে অনেকেই দাঁড়িয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেন। অনেকেই সড়কের পাশে ফুটপাতে পলিথিন টানিয়ে তার নিচে অবস্থান নেন। জুমার নামাজের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মানুষে বৃহস্পতিবার রাতেই ইজতেমা ময়দান পূর্ণ হয়ে যায়। শুক্রবার সকাল থেকেও মানুষ পায়ে হেঁটে ইজতেমা ময়দানে আসতে শুরু করেন। আশপাশের মহাসড়কে যে যেখানে পেরেছেন অবস্থান নিয়ে নামাজে শরীক হয়েছেন। মাওলানা সাদ কান্ধলভীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ কান্ধলভী জুমার নামাজে ইমামতি করেন।
জুমার নামাজের সময় ঘনিয়ে আসতেই আশপাশে মুসল্লিদের মধ্যে ছোটাছুটি শুরু হয়। এ সময় কারও হাতে নামাজের বিছানা, কারও হাতে পাটি, পেপার। নামাজের আকামত শুরু হতে বন্ধ হয়ে গেল সব ছোটাছুটি। যে যেখানে ছিলেন, বিছানা পেতে দাঁড়িয়ে পড়লেন নামাজে। মুসল্লিদের সিজদায় মাথা নোয়ানোর মাধ্যমে নীরবতা নেমে এল পুরো এলাকায়। পাঁচ দিন বিরতির পর শুক্রবার সকালে আমবয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দ্বিতীয় পর্বের বিশ্ব ইজতেমা। এ পর্বে অংশ নিতে আসা মুসল্লিতে ভরে যায় পুরো ইজতেমা মাঠ। এর মধ্যে ইজতেমার জামাতের সঙ্গে জুমা নামাজ পড়তে শুক্রবার সকাল ৮টা থেকেই দল বেঁধে ইজতেমা মাঠের দিকে আসতে থাকেন রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের এলাকার সাধারণ মুসল্লিরা।
এদিকে বাদ ফজর আম বয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। প্রথম পর্বের ইজতেমায় অংশ নেন মাওলানা জোবায়েরের অনুসারীরা, এবার বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে অংশ নিয়েছেন দিল্লির মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারীরা। পাকিস্তানের মাওলানা ওসমানের আম বয়ানের মধ্যদিয়ে ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করেন। তাৎক্ষণিকভাবে তা মাওলানা জিয়া বিন কাসিম বাংলায় তরজমা করেন। ময়দানে অবস্থানরত বিদেশিদের জন্য মূল বয়ানটি আবার তাদের নিজ নিজ ভাষায়ও তাৎক্ষণিক অনুবাদ করা হচ্ছে।
বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের মিডিয়া সমন্বয়ক মোহাম্মদ সায়েম বলেন, বুধবার থেকেই দলে দলে তাবলীগের মানুষরা ইজতেমা ময়দানে এসে অবস্থান নিয়েছেন। দলে দলে মাঠের ভেতরে ঢুকে নিজ নিজ জেলার খিত্তায় অবস্থান নিয়েছেন। ইজতেমা ময়দানে বিদেশি মেহমানদের জন্য পশ্চিম-উত্তর দিকে আলাদা তাবু নির্ধারিত রয়েছে। সেখানে আধুনিক সব ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মানুষদের অবস্থানের জন্য দ্বিতীয় পর্বে পুরো ইজতেমা ময়দানকে জেলা ওয়ারী ৮৫টি খিত্তায় ভাগ করা হয়েছে। রোববার আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মানুষের এ আগমন অব্যাহত থাকবে।
ইজতেমায় মাওলানা সাদ কান্ধলভীর ছেলেদের অংশগ্রহণ : ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারীরা অংশ নিলেও সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকায় ইজতেমায় অংশ নিতে পারেননি তাবলিগ জামাতের শীর্ষ এই আমির। তবে এবার তাঁর তিন ছেলে ও জামাতা অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে মাওলানা সাদ কান্ধলভির বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ কান্ধলভি জুমার নামাজ পড়িয়েছেন। ইজতেমায় অংশ নেওয়া তার অন্য দুই ছেলে হলেন মাওলানা সাঈদ বিন সাদ কান্ধলভি এবং ছোট ছেলে মাওলানা ইলিয়াস বিন সাদ কান্ধলভি। এ ছাড়া তাঁদের এবারের ইজতেমায় সঙ্গে এসেছেন সাদ কান্ধলভির জামাতা মাওলানা হাসান।
জানা গেছে, মাওলানা সাদ কান্ধলভিকে আমির হিসেবে মেনে নেয়া নিয়ে মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীদের মধ্যে বিরোধ চলছে। এই বিরোধের জেরে ২০১৭ সাল থেকে মাওলানা সাদ কান্ধলভিকে ইজতেমায় আসতে দেয়া হচ্ছে না। সরকারিভাবেও নিষেধ করা হচ্ছে। এ কারণে এবার মাওলানা সাদের পরিবর্তে ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন তাঁর তিন ছেলে ও এক জামাতা। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে তাঁরা ইজতেমা মাঠে পৌঁছান।
বিশ্ব ইজতেমায় দ্বিতীয় পর্বে যোগ দিতে তুরাগতীরে এখন মুসল্লিদের ঢল। এর মধ্যে শুক্রবার জুমার নামাজে যোগ দিতে বাইরে থেকেও প্রচুর লোক এই ইজতেমায় যোগদান করেন। কেউ বাস, কেউ মোটরসাইকেল আবার কেউবা হেঁটে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পৌছান ইজতেমা মাঠে দিকে। বেলা ১১টার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও ঢাকা-আশুলিয়া সড়ক ঘুরে জুমার নামাজে অংশ নিতে আসা মুসল্লিদের ঢল দেখা গেছে। ছুটির দিন হওয়ায় আজ অনেকেই দল বেঁধে ইজতেমা মাঠে নামাজ আদায় করতে আসেন। তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধের কারণে এবারও বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে আলাদাভাবে। মাওলানা সাদ কান্ধলভির বিরোধী হিসেবে পরিচিত মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীরা ইজতেমা পালন করেন ১৩ থেকে ১৫ জানুয়ারি। দ্বিতীয় পর্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারীদের ইজতেমা। তাঁদের ইজতেমা চলবে আগামীকাল রোববার পর্যন্ত। এ দিন সকালে আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে এ বছরের মতো ইজতেমা শেষ হচ্ছে।
বিশ্ব ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়কারী মোহাম্মদ সায়েম বলেন, ইজতেমার এই পর্বে আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করবেন মাওলানা সাদ কান্ধলভীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভী। মাঝখানে মহামারীর কারণে দুই বছর ইজতেমার কার্যক্রম বন্ধ ছিল।
এদিকে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বও ভালভাবে শেষ করতে ব্যাপক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন গাজীপুর মেট্টোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রথম পর্বের মতো দ্বিতীয় পর্বও ভালভাবে শেষ করতে চাই। তার জন্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রথম পর্বের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আরও সতর্কভাবে এ পর্ব সম্পন্ন হবে। আগের সব জনবল ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় ১০ হাজার সদস্য ইজতেমায় কাজ করছেন। তিনি জানান মুসল্লিদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুরো ইজতেমা ময়দানকে কয়েকটি সেক্টরে ভাগ করে নিরাপত্তা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
আগে এক মঞ্চ থেকেই একবারই বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন হতো। কিন্তু মাওলানা জোবায়ের এবং মাওলানা সাদ পক্ষের অনুসারীরা এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিভেদে জড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে দুই পক্ষ বিশ্ব ইজতেমা দুইবারে করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ভোরের আকাশ/আসা