logo
আপডেট : ২৫ জানুয়ারি, ২০২৩ ১১:২১
দশ চক্রের অভিনব চুরি
রপ্তানি পণ্যের কার্টনে বালু
ইমরান আলী

রপ্তানি পণ্যের কার্টনে বালু

ইমরান আলী: কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না রপ্তানি খাতের পোশাক চুরি। অভিনব পদ্ধতিতে রাস্তার মাঝ থেকে গায়েব হয়ে যাচ্ছে কাভার্ডভ্যানের এক-তৃতীয়াংশ পণ্য। চুরি করা পণ্যের বদলে ঝুট বা বালু ভরে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে বিদেশে। এতে দেশের ভাবমূর্তি যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়ছে দেশের পোশাকশিল্প খাত। ব্রাজিল থেকে পাঠানো একটি ভিডিওতে দেখা যায়, বায়ার একে একে পোশাকের কার্টন খুলছেন।

 

যার কোনোটি খালি, আবার কোনোটিতে পণ্য আছে অর্ধেক। এমন ঘটনা গত কয়েক বছরে ঘটেছে শতাধিক। গত বছর ডিসেম্বরে কাভার্ডভ্যান বোঝাই কোটি টাকার পোশাক জার্মানির উদ্দেশে পাঠায় সেলিব্রেটি এক্সপোর্ট গার্মেন্টস লিমিটেড। কিন্তু কাভার্ডভ্যানটি ডেমরার একটি প্যাকেজিং কারখানায় নিয়ে যান চালক। যদিও সে যাত্রায় সফল হতে পারেনি চোর চক্র। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সেখানে হানা দেয় র‌্যাব-৪-এর একটি দল। সে সময় হাতেনাতে আটক করা হয় কাভার্ডভ্যানের চালকসহ চোর চক্রের ৭ জনকে।

 

র‌্যাব জানায়, রাজধানীর মিরপুর, উত্তরাসহ আশুলিয়া, সাভার ও গাজীপুরের বিভিন্ন ফ্যাক্টরি থেকে গার্মেন্টস মালামাল বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করার উদ্দেশে চট্টগ্রাম বন্দরের নেয়ার সময় পথে কিছু কিছু কাভার্ডভ্যান থেকে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ দামি গার্মেন্টস মালামাল চুরি হয়। এমন একটি অভিযোগ পেয়ে ছায়া তদন্তে নামে র‌্যাব। একপর্যায়ে ফ্যাক্টরি থেকে মালামাল চট্টগ্রাম বন্দরে নেয়ার সময় পথিমধ্যে কাভার্ডভ্যান থামিয়ে গার্মেন্টস পণ্য চুরি করার সময় গত শুক্রবার রাতে র‌্যাব-৪-এর একটি দল রাজধানীর ডেমরা থানার একটি প্যাকেজিং ভবনের সামনে এবং ওই ভবনের দ্বিতীয় তলায় অভিযান চালায়।

 

অভিযানে ৫ কোটি টাকা দামের চোরাইকৃত প্রায় ২৫ হাজার পিস গার্মেন্টসসামগ্রী একটি কাভার্ডভ্যানসহ মো. তাওহিদুল কাউছার, মো. নাজিম, মো. মাসুদ, মো. দুলাল, মো. মিরাজ উদ্দিন, আব্দুল আল মাসুদ এবং মো. সাইফুল ইসলাম নামের সাতজন সংঘবদ্ধ আন্তঃজেলা ডাকাত চক্রের সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে র‌্যাব জানায়, গ্রেপ্তাররা পরস্পর যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা, আশুলিয়া ও গাজীপুর থেকে বিভিন্ন দেশে রপ্তানির গার্মেন্টস মালামাল চুরির ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছে।

 

তারা মালামাল পরিবহনে নিয়োজিত চালকদের সঙ্গে সংঘবদ্ধ হয়। এরপর একটি দুর্ধর্ষ ডাকাত চক্র গঠন করে পরস্পর যোগসাজশে বিগত কয়েক বছর ধরে গার্মেন্টস মালামাল কাভার্ডভ্যান থেকে ডাকাতি করে স্থানীয় মার্কেটে কমদামে বিক্রি করে আসছিল। এতে করে দেশ প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি গার্মেন্টস মালিকরা প্রতিনিয়ত বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে আসছিলেন। র‌্যাবের ভাষ্যমতে, এ ধরনের কয়েকটি চক্র ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সক্রিয় রয়েছে এবং প্রতি বছর শতকোটি টাকা মূল্যের দেশি পোশাক এসব চক্রের মাধ্যমে চুরি হয়ে যাচ্ছে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রপ্তানি পোশাক চুরি চক্রের অন্তত ১০টি গ্রুপ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে সক্রিয় রয়েছে। কার্ভাডভ্যানের চালক, কিছু অসাধু গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও বন্দরের কর্মকর্তারাও এ চক্রের সঙ্গে জড়িত। আটকদের মধ্যে হিমেল ওরফে দুলাল, সিরাজুল ইসলাম ও তাওহিদুল কাউছার ভিন্ন ভিন্ন গ্যাং পরিচালনা করত। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজধানীর মিরপুর, উত্তরাসহ আশুলিয়া, সাভার ও গাজীপুরের বিভিন্ন ফ্যাক্টরি থেকে গার্মেন্টসের মালামাল বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করার উদ্দেশে চট্টগ্রাম বন্দরে নেয়ার পথে এ চুরির ঘটনা ঘটে।

 

দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা, আশুলিয়া ও গাজীপুর থেকে বিভিন্ন দেশে রপ্তানির গার্মেন্টস মালামাল চুরির ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত চোর চক্রের এসব সদস্যরা। তারা মালামাল পরিবহনে নিয়োজিত চালকদের সঙ্গে সংঘবদ্ধ হয়ে চক্র গঠন করে। পরবর্তীতে পরস্পর যোগসাজশে বিগত কয়েক বছর ধরে গার্মেন্টস মালামাল কাভার্ডভ্যান থেকে ডাকাতি করে স্থানীয় মার্কেটে চোরাইপথে স্বল্পমূল্যে বিক্রি করে আসছিল।

 

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ ধরনের প্রায় অর্ধশত চোর চক্র ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সক্রিয় রয়েছে। প্রতি বছর এসব চক্রের মাধ্যমে শতকোটি টাকা মূল্যের দেশি পোশাক চুরি হয়ে যাচ্ছে। চক্রের সদস্যরা সাধারণত কাভার্ডভ্যানের ড্রাইভারদের সঙ্গে সখ্য তৈরি করে। পরবর্তীতে তাদের বিভিন্ন প্রকার লোভদেখানো ও ডাকাতির মালামাল বিক্রয়ের টাকার একটি অংশ দেয়ার কথা বলে রাজি করানো হয়। এরপর নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নিকটবর্তী নির্জন এলাকার ভেতর কিংবা চক্রের সুবিধাজনক স্থানে কাভার্ডভ্যান পার্কিং করে।

 

পরবর্তীতে কাভার্ডভ্যান তাদের লোড-আনলোড পয়েন্টে নিয়ে আসলে বিশেষ কৌশলে কাভার্ডভ্যানের সিলগালা তালা না খুলে কাভার্ডভ্যানের পাশের ওয়ালের নাট-বোল্ট খোলে। প্রত্যেক কার্টনের ভেতরে থাকা মালামালের ৩০-৪০ শতাংশ রেখে পোশাকের পরিবর্তে কার্টন ও বস্তাভর্তি বালু দিয়ে পূর্ণ করে সঠিকভাবে কার্টন বাঁধাই করে।

 

র‌্যাব সূত্র জানায়, ডাকাত চক্রগুলো কার্টনের মালামালের ওয়েট ঠিক রাখার জন্য যে পরিমাণের মালামাল কার্টন থেকে চুরি করে সরিয়ে রেখে একই ওজনের ঝুট, বালু কার্টনের ভেতর মাঝখানে দিয়ে কার্টন প্যাকেট করে। যার ফলে বন্দরে স্ক্যানিং কিংবা ওয়েট মেশিনে কোনো ধরনের অনিয়ম ধরা পড়ে না। এছাড়া মাঝে মাঝে তারা মালামালসহ সম্পূর্ণ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানও লুট করে। চক্রের অন্যতম সদস্য তাওহীদুল কাউছার বরিশাল জেলার উজিরপুর থানার যোগীকান্দা গ্রামের বাসিন্দা।

 

এ-প্লাস গ্রুপের এমডি তমিজ উদ্দিন বলেন, ৬ জানুয়ারি বিদেশি বায়ারদের কাছ থেকে আমরা কিছু ভিডিও ক্লিপ পাই। সেখানে ওরা ইনভেস্টিগেশন বা ইন্সপেকশন করছে মালামালগুলো। কার্টন খুলে তারা বেশকিছু খালি পেয়েছে। আর কিছু কার্টনে যেখানে ১০ পিস পোশাক থাকার কথা, সেখানে দেখা গেছে ৩ পিস বা ৭ পিস। ট্রেন্ড এন স্টাইল লিমিটেডের এমডি আবু মোহাম্মদ খান বলেন, এ ধরনের ঘটনা আমাদের জন্য কাম্য নয়। এটি আমাদের জন্য খুবই কষ্টের এবং লজ্জাজনক। সেলিব্রেটি এক্সপোর্ট গার্মেন্টস লিমিটেডের এমডি শরিফ আহমেদ বলেন, এ অবস্থায় বায়ার আমাকে যা বলবে তাই মেনে নিতে হবে। কারণ তার সঙ্গে আমি ব্যবসা করব।

 

র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ আব্দুর রহমান বলেন, এখন পর্যন্ত যাদের গ্রেপ্তার করেছি, তাদের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখেছি, এরা কোনো না কোনোভাবে পোশাকশিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল। তাদের সঙ্গে যে গার্মেন্টেসের পণ্য চুরি হচ্ছে সেই গার্মেন্টেসের কর্মচারী বা অন্য কারো সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা, তা তদন্ত করে দেখছি। আমরা খুব শিগগির হয়তো টোটাল চেইনটা জানতে পারব। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পরিচালক রাজিব চৌধুরী বলেন, এমন আসামিদের সাধারণ চুরির মামলা দেয়া উচিত নয়।

 

এদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহী মামলা হওয়া উচিত। কারণ যারা এ কাজের সঙ্গে জড়িত, তারা শুধু একটা কারখানার ক্ষতি করছে না, বাংলাদেশের সম্পদের ক্ষতি করছে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এটা কোনোভাবেই আমরা মেনে নিতে পারছি না। রাস্তার মধ্যে গাড়িগুলো কোথাও নিয়ে গিয়ে, গাড়ি থেকে মালামাল বের করে নিয়ে যাবে। এরপর এটা বায়ারের কাছে গেলে তা তো আমাদের মানসম্মানের প্রশ্ন, অস্তিত্বের প্রশ্ন এখানে।

 

এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, যারা এ অভিযোগ করেছেন বা যারা এ সমস্যায় ভুগছেন তারা বাণিজ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে যদি সমাধান না পায়, তাহলে আইন মন্ত্রণালয়ে এলে অবশ্যই ব্যাপারটা দেখব। এ সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করব। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে রপ্তানি পোশাক চুরি হতে থাকলে ধ্বংস হয়ে যাবে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ খাত। চোর চক্রের মূল উৎপাটনে অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

 

ভোরের আকাশ/নি