নিখিল মানখিন: নানান দূষণের কবলে পড়েছে দেশ। চলতি সপ্তাহে চার দিন বিশ্বের বায়ুদূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ঢাকা। আন্তর্জাতিক সমীক্ষার সর্বশেষ প্রতিবেদনে বায়ুদূষণে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশের তালিকায় রয়েছে দেশ। বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেটের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে দূষণে মৃত্যুর সংখ্যাতেও বাংলাদেশ রয়েছে ষষ্ঠ অবস্থানে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের পরিবেশ আজ চরম সংকটে পড়েছে। আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে পরিবেশ দূষিত হওয়ার মাত্রা। পরিবেশ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্র্যের ওপর। গত এক যুগে দূষণ ও পরিবেশের বিচারে বাংলাদেশ পিছিয়েছে। পরিবেশের বিপর্যয় মানে জীবনের বিপর্যয়। যে কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েছে বহুগুণ। পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ’ শীর্ষক সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষণে মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ।
প্রতিবেদনে পরিবেশদূষণকে বিশ্বে রোগ বিস্তারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ঝুঁকির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মাটি, পানি ও বায়ুদূষণের কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ক্ষতি ও স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাবগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। পানিতে আর্সেনিক সমস্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে আছে বাংলাদেশ, ভারত ও চীন। পানিতে আর্সেনিকের কারণে ক্যানসার, কিডনিজনিত রোগ, হৃদ্রোগ ও স্নায়ুজনিত রোগে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
বায়ুদূষণে বিশ্বে শীর্ষে বাংলাদেশ : আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সে প্রকাশিত বিশ্বের ৬ হাজার ৪৭৫টি শহরের দূষণের তথ্যভিত্তিক সর্বশেষ সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ সবচেয়ে দূষিত দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। এছাড়া ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত রাজধানী হিসেবে তালিকায় উঠে এসেছে। সমীক্ষায় প্রথমবারের মতো আফ্রিকার দেশগুলোর তথ্য নেয়ায় চাদ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
দূষিত শহরের তালিকায় ফের শীর্ষে ঢাকা : বায়ুর মান হিসেবে বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় টানা তিন দিন শীর্ষে থাকার পর গত ২৪ জানুয়ারি এক ধাপ নেমে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল রাজধানী ঢাকা। তবে গতকাল বুধবার ফের শীর্ষে উঠে এসেছে শহরটি।
জিইপি ইনডেক্সে ১৬২তম স্থানে বাংলাদেশ : সর্বশেষ প্রকাশিত ‘গেøাবাল এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স (জিইপি) ইনডেক্স অনুযায়ী, বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২ নম্বরে। পরিবেশ ও জীবনমানের ওপর এর প্রভাব নিয়ে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বৈশ্বিক সূচক প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, জনস্বাস্থ্যের ওপর দূষণের প্রভাবসহ আট বিষয় বিবেচনা করে ১০০ স্কেলে বাংলাদেশের স্কোর ২৯, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে তৃতীয় সবচেয়ে খারাপ অবস্থান অর্জন করে।
জলবায়ু ও পরিবেশ : পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মো. রইছউল আলম মন্ডল জানান, পরিবেশ ও জীবন একে অপরের পরিপূরক। পরিবেশ অনুক‚লে থাকলে অব্যাহত থাকে জীবনচক্র। পরিবেশের বিপর্যয় মানে জীবনের বিপর্যয়। প্রাণিস্বাস্থ্য, প্রাণী উৎপাদন ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তন একটি আন্তঃসম্পর্কিত জটিল প্রক্রিয়া, যার ওপর অনেকাংশেই নির্ভর করে রোগের প্রাদুর্ভাব, উৎপাদন ব্যবস্থাসহ আরো অনেক কিছু।
বৈরী জলবায়ুর করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পাচ্ছে না বাংলাদেশও। এর পাশাপাশি যোগ হয়েছে পরিবেশদূষণ। দূষণের দোষে দূষিত হয়ে উঠছে চারপাশ। শিল্পবর্জ্য, মেডিকেল বর্জ্য, প্রাণিজ এবং অন্যান্য বর্জ্যসহ বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্র্যের ওপর। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন পরিবেশ, যা অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের জন্য বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না।
শব্দদূষণে স্বাস্থ্যহানি : মহানগরী ঢাকায় সহনীয় মাত্রার দেড় থেকে দুগুণ বেশি শব্দ বিরাজ করছে। শব্দদূষণের কারণে উচ্চরক্তচাপ, অনিদ্রা, শ্রবণশক্তি হ্রাস, মনঃসংযোগ কমে যাওয়া, মাথাব্যথা ও মাথা ধরার জটিলতায় ভুগছে নগরবাসী। শুধু তাই নয়, রাজধানীবাসীকে খিটখিটে মেজাজ, বিরক্তিবোধসহ অস্বাভাবিক আচরণ করার মতো মানসিক ও দৈহিক নানা সমস্যার পড়তে হচ্ছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) পরিচালিত বিভিন্ন স্থানের শব্দের মাত্রা পরিমাপের ভিত্তিতে পরিচালিত জরিপ প্রতিবেদনে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
পানি দূষণমুক্ত রাখতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই : নদীর পানি দূষণমুক্ত করতে আইনের কার্যকরী প্রয়োগের উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বর্তমানে দেশের অনেক নদী রাজনৈতিক দল মদদপুষ্ট ভ‚মিদস্যুদের দখলে যাওয়া এবং পানি ও পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় নদী দখল ও দূষণ বাড়ছে। বাংলাদেশে পানি খাতের ব্যবস্থাপনায় সরকারের অন্তত ১৩টি মন্ত্রণালয় যুক্ত থাকায় খাতটিকে অনেক জটিল উল্লেখ করেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিবেশ রক্ষায় গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন : পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেছেন, বাসযোগ্য পরিবেশ উপহার দিতে প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাসহ দেশের পরিবেশ উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। পরিবেশকে দূষিত করে এবং জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে এমন কাজ কাউকেই করতে দেয়া হবে না। দেশের পানি, বায়ু, শব্দদূষণসহ সব ধরনের দূষণ রোধ করে সার্বিক পরিবেশের উন্নয়নের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা ডেকে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণপূর্বক সেভাবে কাজ করা হবে।
বেড়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, বেঁচে থাকার জন্য আমরা পরিবেশকে নানাভাবে ব্যবহার করি। ফলে পরিবেশে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে। এ পরিবর্তনের যখন জীবের জন্য ক্ষতিকর হয়, তখন তাকে পরিবশে দূষণ বোঝায়। বিভিন্ন ক্ষতিকর ও বিষাক্ত পদার্থ পরিবেশে মিশলে পরিবেশ দূষিত হয়।
দূষিত বায়ু মানুষের শ্বাসকার্যে ব্যাঘাত ঘটায় এবং দেহে নানা রোগ সৃষ্টি করে। দূষিত বায়ুর কারণে মানবদেহে অ্যালার্জি, কাশি, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, উচ্চরক্তচাপ, মাথাব্যথা, ফুসফুসে ক্যানসার ইত্যাদি মারাত্মক রোগ হতে পারে। মোট কথা বায়ুদূষণ বাড়তে থাকলে সে স্থানটি মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। তাই বায়ুদূষণের ফলে মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়। মানুষের আয়ু হ্রাস করে। সর্বোপরি মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অসহনীয় হয়ে পড়ে বলে জানান অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ।
বাংলাদেশের পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের নেতা এবং প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলছেন, পরিবেশদূষণের বেশ কয়েককটি ভাগ রয়েছে। যেমন বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, খাদ্যদূষণ ইত্যাদি। এর সবগুলোর ফলেই কোনো না কোনোভাবে মানুষ ক্ষতির শিকার হচ্ছে। পরিবেশদূষণে শিশুদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ব্যাহত এবং স্নায়ুর ক্ষতি হয়। গর্ভবতী মহিলাদের শারীরিক ক্ষতি হয়। বায়ুদূষণে চোখ ও শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি হয়। আক্রান্ত হয় ক্যানসার ও হৃদরোরোগে।
পানিদূষণের প্রভাব অনেক দীর্ঘস্থায়ী এবং পানিবাহিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যাও অগণিত। খাদ্যচক্রের মাধ্যমে ক্ষতির শিকার হয় মানুষ। শব্দদূষণের কারণে আক্রান্ত হয় হাইপার টেনশনে। আর খাদ্যদূষণে মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ লিভার, কিডনি বা পাকস্থলি কার্যকারিতা হারাচ্ছে।
পরিবেশ রক্ষায় সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করার আহব্বান জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। তিনি সম্প্রতি রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, মানুষ হিসেবে টিকে থাকার জন্য পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত প্রয়োজন। তবে এজন্য নেতিবাচক মনোভাব থেকে বের হয়ে আসতে হবে, যা আছে সেখান থেকে আমাদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শুরু করতে হবে।
ভোরের আকাশ/নি