logo
আপডেট : ২৭ জানুয়ারি, ২০২৩ ১৬:৫৯
জেলা প্রশাসক সম্মেলন-২০২৩ সম্পন্ন
জাতীয় নির্বাচন প্রস্তুতির নির্দেশনা ডিসিদের
মো. রেজাউর রহিম

জাতীয় নির্বাচন প্রস্তুতির নির্দেশনা ডিসিদের

মো. রেজাউর রহিম: এবারের জেলা প্রশাসক সম্মেলনে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ের প্রশাসনকে আরো জনসেবামূলক ও কার্যকর ভূমিকা রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যেকোনো সংকট মোকাবিলায় পরিস্থিতির ঊর্ধ্বে থেকে সততার সঙ্গে মাঠপর্যায়ের প্রশাসনকে জনসেবা করতে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনব্যাপী জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন-২০২৩ সম্পন্ন হয়েছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন থাকায় এবারের জেলা প্রশাসক সম্মেলন ছিল ভিন্নমাত্রার। গতকাল ছিল সম্মেলনের শেষদিন। এদিন আগামী বছর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যথাযথ ভূমিকা রাখার জন্যও সরকারের পক্ষ থেকে ডিসিদের নির্দেশনা দেয়া হয়।

 

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবারের সম্মেলনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, জ্বালানি ও পণ্য মূল্যস্ফীতি এবং সার্বিকভাবে সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর সর্বোচ্চ জোর দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে যেকোনো মূল্যে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখান জন্য ডিসিদের বলা হয়। এছাড়া করোনা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসায় অর্থনৈতিক কার্যক্রমের গতিবৃদ্ধির পাশাপাশি জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে প্রশাসনকে আরো গতিশীল করার বিষয়টিও ছিল এবারের আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাশাপাশি সার্বিকভাবে সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলায় এবং উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা বৃদ্ধিতে জেলা প্রশাসকদের দক্ষ, দুর্নীতিমুক্ত ও সেবামুখী প্রশাসন বাস্তবায়নের জন্য সম্মেলনে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। রমজান ও ঈদ সামনে থাকায় বাজারে পণ্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া এবং কঠোরভাবে বাজার তদারকির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ডিসিদের। গতকাল সম্মেলনের শেষদিনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান আগামী নির্বাচনে নিজেদের ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করার জন্য ডিসিদের প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন।

 

জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রশাসনের অনেক ভূমিকা রয়েছে। আমরা ডিসিদের বলেছি, একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন যেটা দেশবাসী চাচ্ছে, সারাবিশ্ব ও সেভাবে তাকিয়ে আছে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য আপনারা তৈরি থাকুন, যাতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পারেন। আগামীতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

 

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী এখন যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম। নির্বাচনের সময় তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা দিয়ে যেকোনো পরিস্থিতি তারা মোকাবিলা করতে পারবেন। তিনি বলেন, বস্তুত নির্বাচনের সময় সময় আমাদের করণীয় কিছু থাকবে না। মন্ত্রণালয় শুধু রুটিন ওয়ার্ক করবে। মূল দায়িত্ব থাকবে ইলেকশন কমিশন (ইসি)। নির্বাচনের সময় নিরাপত্তা বাহিনী তাদের কাছেই ন্যস্ত হবে। এছাড়া মাদক নির্মূলের বিষয়ে ডিসিদের জোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মাদক আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স নীতির কথা তাদের বলেছি। এ বিষয়ে ডিসিরা মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারবেন। মাদকের চাহিদা কমানোর জন্য ডিসিরা যাতে কাজ করেন, সে কথা বলেছি। এটা না করতে পারলে আমাদের উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন ২০৩০, ২০৪১ তা হয়তো অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এজন্য মাদক নির্মূলের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এছাড়া ডিসিদের সঙ্গে বৈঠকের পর ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, আমাদের ভূমি কর এখন অনলাইনে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে, তবে বর্তমানে এটা ম্যানুয়ালিও আছে। আগামী পহেলা বৈশাখ থেকে ম্যানুয়াল পদ্ধতি বন্ধ করে ভূমিকর দেয়ার ব্যবস্থা শতভাগ অনলাইনে করা হবে। দেশে খাস জমির পরিমাণ নির্ধারণে ল্যান্ড ডাটা আপডেট করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রত্যেক জেলার ডিসিকে বলা হয়েছে, তাদের জেলার খাস জমি যেন বেশি করে রিকভার করতে পারেন। কারণ আমাদের খাস জমিগুলো অনেকভাবে বেহাত হয়ে পড়ে আছে। পাশাপাশি ভূমি ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে সারা দেশে ডিজিটাল ল্যান্ড সার্ভের কাজ শুরু করা হয়েছে। বরগুনা ও পটুয়াখালী, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে এটা শুরু করা হয়েছে। এ জেলাগুলোয় শেষ করার পর আমরা সারা দেশে ডিজিটাল সার্ভের কাজ শুরু করব। ভূমি সংশোধন, খাসজমি উদ্ধারের বিষয়ে ভূমিমন্ত্রী বলেন, আমরা এগুলো নিয়ে কাজ করছি। এক্ষেত্রে এসিল্যান্ডদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।

 

নদীতে সেতু নির্মাণে বিআইডব্লিউটিএর অনুমোদন নিতে হবে : এদিকে সম্মেলনে নদীর ওপর সেতু নির্মাণে এখন থেকে বিআইডব্লিউটিএর অনুমোদন নিতে হবে বলে ডিসিদের জানানো হয়েছে। ডিসিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিআইডব্লিউটিএর অনুমোদন ছাড়া নদীর ওপর কোনো সেতু নির্মাণ করা যাবে না। তিনি বলেন, আমাদের দেশের নদীগুলোয় বিভিন্ন ধরনের জাহাজ চলাচল করে। এক্ষেত্রে কোন নদীতে কোন জাহাজ চলাচল করবে, সেটা মাথায় রেখেই ব্রিজগুলো নির্মাণ করতে হবে। এজন্য বিআইডব্লিউটিএর অনুমোদন ছাড়া সড়ক, এলজিইডি, সেতু বিভাগ কেউই যেন কোনো সেতু নির্মাণ করতে না পারে, সে বিষয়ে জেলা প্রশাসকদের তদারক করতে বলা হয়েছে। এছাড়া সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন দেশের কেউ যাতে অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার পথে পা না বাড়ায় সে ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করাসহ ডিসিদের বেশকিছু নির্দেশনা নিয়েছেন। ডিসি সম্মেলনের শেষদিনে বৈঠক থেকে বের হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, অবৈধভাবে কেউ যেন বিদেশে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও হয়রানির শিকার না হয়, সেজন্য ডিসিদের বলা হয়েছে। এছাড়া অনেক প্রবাসীর বাড়ি দখল হয়ে যায় এবং তারা হয়রানির মুখে পড়েন। মামলায় কেউ কেউ জেলেও গেছেন। এসব ক্ষেত্রে প্রবাসীদের সুরক্ষা দিতে ডিসিদের জানানো হয়েছে।

 

জনপ্রশাসনের অর্থ ব্যয়ে ক্ষমতা চান জেলা প্রশাসকরা : এদিকে জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন প্রকল্প ও কাজের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ অর্থ ব্যবহারের ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিতে চান জেলা প্রশাসকরা। বর্তমানে এ বরাদ্দ দেখভাল করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। এ দায়িত্ব পালন করেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা। জানা গেছে, ডিসি সম্মেলন শুরুর আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব দিয়েছেন পিরোজপুর ও ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক। তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের আয়-ব্যয় কর্মকর্তার দায়িত্ব জেলা প্রশাসককে দেয়ার প্রস্তাব করেছেন। প্রস্তাবে দুই জেলা প্রশাসক উল্লেখ করেছেন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, সার্কিট হাউস, জেলা প্রশাসকের বাসভবনসহ জেলা পর্যায়ে ছয়তলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ে ১২ তলা সার্কিট হাউস ও কনভেনশন সেন্টার প্রকল্পগুলো গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়। এতে প্রকল্পের প্রাক্কলন, ডিজাইন ও মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে এবং গুণগতমান বজায় রেখে প্রকল্প বাস্তবায়নে সমস্যা হয়। এখানে জেলা প্রশাসকদের আয়-ব্যয় কর্মকর্তা নিয়োগ করা হলে প্রকল্পের প্রাক্কলনসহ কাজের চাহিদা নিরূপণ সহজ হবে।

 

এছাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের (ইউএনও) আবাসিক ভবনে সান্ধ্যকালীন অফিস করতে জনবল চেয়ে প্রস্তাব করেছেন জামালপুরের জেলা প্রশাসক। প্রস্তাবে তিনি উল্লেখ করেছেন, উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজে অফিসের বাইরে অবস্থান করতে হয়। ফলে অফিস সময়ে সব কার্যাদি সম্পাদন সম্ভব হয় না। এছাড়া উপজেলায় ভিআইপি অতিথি এলে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বাসভবনে আপ্যায়নের কাজে অন্য কর্মচারীদের সম্পৃক্ত হতে হয়। এজন্য অফিস সময়ের পর অফিসের কার্যাদি নির্বিঘ্নে সম্পাদন করার জন্য আবাসিক কার্যালয়ে একটি করে সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা (পূর্বপদ সাঁটমুদ্রাক্ষরিক), অফিস সহায়ক, পরিচ্ছন্নতাকর্মীর পদ সৃজন করা প্রয়োজন বলে প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে তিন দিনব্যাপী বার্ষিক জেলা প্রশাসক সম্মেলন-২০২৩ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জেলা প্রশাসকদের সারা দেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়া এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের ব্যবস্থা গ্রহণসহ ২৫টি নির্দেশনা বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন তিনি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে এটাই এ সরকারের শেষ ডিসি সম্মেলন। দেশের ৬৪ জেলার ডিসি এবং আট বিভাগীয় কমিশনার এ সম্মেলনে অংশ নেন। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এবারের ডিসি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/আস