নিখিল মানখিন: চিকিৎসা সেক্টরে অনেক দূর এগিয়েছে দেশ। বর্তমানে দেশে সব ধরনের রোগের সর্বশেষ অত্যাধুনিক চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে। এমনটি দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, চিকিৎসা সেক্টরের সেবার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। বেড়েছে মানুষের গড় আয়ু। চিকিৎসা সেক্টরে জনবল বৃদ্ধি, অবকাঠামোর উন্নয়ন, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, ওষুধের সরবরাহ বৃদ্ধি, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, কমিউনিটি ক্লিনিক চালু, চিকিৎসা খাতে ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যক্রম ইত্যাদি উন্নয়নমূলক উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সফলতা পেয়েছে সরকার। পোলিও ও ধনুষ্টংকার মুক্ত হয়েছে দেশ। শুধু বিস্ফোরিত জনসংখ্যা ও সীমিত সম্পদের কারণে অনেক সময় সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসাসেবা প্রদান ও গ্রহণ ব্যাহত হয়ে থাকে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানেরও অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। বর্তমানে দেশে রোগ নির্ণয় ও রোগ সারাতে যেমন অগ্রগতি হয়েছে, তেমনি মানুষের সুস্থ জীবন-যাপনের নিশ্চয়তা বাড়াতে নানা ধরনের গবেষণা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। বিদেশ গমন রোগীদের সংখ্যা কমেছে। জয় করা গেছে বহু দুরারোগ্য ব্যাধি, শল্য চিকিৎসায় অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে, জিনতত্ত্ব জানার সঙ্গে সঙ্গে উন্মোচন হয়েছে অনেক জটিল রোগের কারণ ও ব্যাখ্যা। দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে কোনো বিষয়েই পাঠ্যপুস্তকের বিপুল সমাহার হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন রকমের চিকিৎসাবিষয়ক জার্নালের ছড়াছড়ি। এসব প্রকাশনা বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত, রং-বেরংয়ের ছবি ও পরিসংখ্যান সংবলিত সহজ-সরল ভাষায় উপস্থাপিত হওয়ায় দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞান হয়েছে আরো সমৃদ্ধশালী।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আরো বলেন, দেশে বর্তমানে অনেক অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন প্রাইভেট ল্যাবরেটরির ছড়াছড়ি, যা দেখলে অবাক না হয়ে উপায় নেই। যেকোনো রকম রক্তের বায়োকেমিক্যাল পরীক্ষা, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, এমআরআই, সিটি স্ক্যান ইত্যাদি অনেক সহজেই করা সম্ভব। দেশে এমআরআইয়ের ব্যবহার অবশ্যই এক যুগান্তকারী সংযোজন, যার মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের, বিশেষ করে ব্রেন ও হাড়ের অনেক জটিল রোগ অতি সহজেই নিরূপণ করা সম্ভব হচ্ছে। দেশে বিজ্ঞানের কল্যাণে আরো অনেক অজানা জটিল রোগ নির্ণয়ে অভাবনীয় অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ল্যাবরেটরি ও প্যাথলজির পরীক্ষা-নিরীক্ষা আজ অনু-পরমাণু পর্যায়ে রোগের কারণ ও ধরন নির্ণয় করতে পারছে। জেনেটিক এনালাইসিস, ক্রমোজোমাল এনালাইসিস, ক্যারিওটাইপিং, মলিকুলার বায়োকেমিস্ট্রি ও ইমিউনলজি রোগের ধরন-ধারণ-কারণ ব্যাখ্যা করতে পারছে একেবারে সঠিক পদ্ধতিতে। রেডিওলজির অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছে, ইমাজিংয়ের নিত্যনতুন পদ্ধতি আবিষ্কার দেহের ভেতরকার সমস্ত চিত্রই তুলে আনতে পারছে নির্ভুলভাবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, দেশে রোগ আরোগ্যের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারের পর থেকেই এগিয়ে গেছি আমরা, জীবাণু ও সংক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হার মেনে বিদায় নিয়েছে অনেক জটিল ব্যাধি। একসময়কার ভয়াবহ রোগ বলে বিবেচিত কলেরা, প্লেগ, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, গুটিবসন্ত, টিটেনাস ইত্যাদি ভয়াবহ রোগের চিকিৎসায় সফলতা পেয়েছে দেশ। নিত্যনতুন ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে, ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি ও বাইপাসসহ বিভিন্ন রকমের অত্যাধুনিক কার্ডিয়াক সার্জারি বর্তমানে বাংলাদেশেও মানুষের হাতের মুঠোয়। কিডনি বিকল হওয়ার চিকিৎসায় ডায়ালাইসিস এবং সফল কিডনি প্রতিস্থাপন এখন হরহামেশাই হচ্ছে, এমনকি সম্ভব হয়েছে লিভার, প্যানক্রিয়াস ও অন্যান্য টিস্যু প্রতিস্থাপনও। ক্লোনিং পদ্ধতিও চালু রয়েছে দেশে। এভাবে দেশে প্লাস্টিক সার্জারি এন্ডোস্কপিক সার্জারি, লেসার সার্জারি, গামা নাইফ সার্জারি ইত্যাদির কারণে বড় ধরনের কাটাছেঁড়া ছাড়াই সম্ভব হচ্ছে বড় ধরনের অপারেশন। লেজার সার্জারি, ক্রায়োথেরাপি, ইলেক্ট্রোকটারি ইত্যাদির মাধ্যমে নানা রকমের চর্মরোগের সহজ ও কার্যকর চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছে। ধাত্রীবিদ্যায় গর্ভস্থ শিশুর সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা সহজে সম্ভব হওয়ায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া ও সঠিক সমস্যা নিরূপণ করা যাচ্ছে।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সাবেক মহাসচিব ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ ভোরের আকাশকে বলেন, আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা পৃথিবীর অনেক দেশের সমতুল্য অনেক ক্ষেত্রেই। অত্যাধুনিক চিকিৎসা, লেপারোস্কোপি সার্জারি, প্রসিডিউর, ইনভেসিভ প্রসিডিউরের কথা বলেন, এগুলো অনেক এগিয়েছে। দেশে এখন লিভার, বোনম্যারো ও কিডনি প্রতিস্থাপন চলছে। হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের দিকেও এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। ইতোমধ্যে হার্টের চিকিৎসায় নতুন সংযোজন হয়েছে কিছুদিন আগে। স্ট্যাম্প সেল থেরাপি হচ্ছে। এখন এগুলো বিশ্বের সর্বশেষ পদ্ধতি, যা আমাদের দেশেও হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে যে অত্যাধুনিক কার্ডিয়াক সার্জারি, তা আজ আমাদের দেশে হচ্ছে। চোখের যে লেসিক, মাইক্রো সার্জারিসহ অন্যান্য সব জটিল চিকিৎসা আধুনিক বিশ্বের অন্য সব দেশে যা, আমাদের দেশেও তা হচ্ছে।
স্বাচিপ মহাসচিব আরো বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় ১৯৭১ সালে আমাদের দেশে ২০০ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন। আর বর্তমানে ২২ হাজারের মতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক নানা গবেষণা কার্যক্রম চলছে। বেড়েছে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা। বিশেষায়িত হাসপাতাল হচ্ছে। চিকিৎসা সেক্টরের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সুনজর রয়েছে। চিকিৎসার জন্য দেশের মানুষকে আর যাতে বিদেশে যেতে না হয়, বিদেশমুখী বন্ধ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের পাশে নির্মিত সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল আজ উদ্বোধন হওয়ার পথে। এটা অত্যাধুনিক এবং এই হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হলে দেশের মানুষ আর বিদেশে যাবে না। যাদের সামর্থ্য আছে তারা এখানেই সেবা নেবেন।
স্বাচিপ মহাসচিব আরো বলেন, আমাদের দেশের বড় অংশ বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসা নেন। ১৬ কোটি মানুষের জন্য সরকারি পর্যায়ে সব রোগের চিকিৎসা প্রদান এখনো হয়ে ওঠেনি। এটা সত্য। কিন্তু সরকারি পর্যায়ের যে চিকিৎসা ব্যবস্থা আমাদের আছে, তা পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় ভালো এবং এটা কেন্দ্রীয় থেকে মাঠ লেবেল পর্যন্ত বিস্তৃত। সরকারি ব্যবস্থাপনায় কম খরচে চিকিৎসা প্রদানের বিষয়টি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক মেডিকেল সাময়িকী লেনসেট পত্রিকায় তা ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার প্রকাশিত হয়েছে। মনিটরিং সিস্টেম বিশ্বে প্রশংসিত। আন্তর্জাতিক সূচকে এগিয়ে আছি। অনেক আন্তর্জাতিক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে বাংলাদেশ। বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়ারই কথা।
স্বাচিপ মহাসচিব আরো বলেন, বিদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের চিকিৎসার পার্থক্য খুব বেশি আছে বলে মনে করি না। প্রায় একই রকম। আমাদের চেয়ে বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে বরং চিকিৎসা ব্যয় বেশি। অনেকে এ কথা বলেন, ভারতে চিকিৎসা ব্যয় কম। কিন্তু তারা যাওয়া-আসা ও থাকার হিসাবটা বাদ দিয়ে হিসাব করেন। এসব নিয়ে হিসাব করলে দেখা যাবে, আমাদের দেশেই চিকিৎসা ব্যয় কম।
সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, দেশের চিকিৎসাসেবার মান অনেক গুণ বেড়েছে। বিদেশগামী রোগীর সংখ্যা কমেছে। ব্রেন টিউমার, বাইপাস সার্জারির মতো বড় ও জটিল রোগের অপারেশন দেশেই হচ্ছে। কোনো ওষুধের অভাব নেই। এ ছাড়াও কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে। সেখানে ৩০ থেকে ৩২ ধরনের ওষুধ পাচ্ছে রোগীরা।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, দেশে এখন দেড় লাখ শয্যা। প্রতিটি বড় হাসপাতালে আইসিইউ আছে। সাধারণ মানুষ ঠিকমতো চিকিৎসা পাচ্ছে কিনা সেটি নিশ্চিত করতে হাসপাতালের পরিচালনা পর্ষদের মাসিক সভা নিয়মিত করতে হবে। জনপ্রতিনিধি ও হাসপাতালপ্রধানের অনেক দায়িত্ব। ডাক্তার-নার্স ঠিকমতো আসে কিনা সেটি দেখতে হবে। টয়লেট ও বেড ঝকঝকে থাকতে হবে। তবেই হাসপাতালে আন্তর্জাতিক মানের সেবার পরিবেশ ঠিক থাকবে।
জাহিদ মালেক বলেন, করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্যসেবা কিছুটা ব্যাহত হলেও বর্তমানে স্বাস্থ্যসেবাকে কীভাবে আরো উন্নত করা যায়, সে চেষ্টা করে যাচ্ছে সরকার। ইউনিয়ন থেকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্যক্রম মনিটরিংয়ে রাখা হয়েছে। আমাদের অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতির অভাব নেই, কিন্তু জনবলের অভাব রয়েছে। তবে গত ৫০ বছরে যেখানে ১৫ হাজার ডাক্তার নিয়োগ হয়েছে, করোনার দুই বছরে সেটি তিনগুণ বেড়েছে। নার্সও দ্বিগুণ হয়েছে। আমরা কাজ করেছি বলেই স্বাস্থ্যসেবা এগিয়ে গেছে।
ভোরের আকাশ/আসা