বছর কয়ের আগে স্বামীকে হারিয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে সংকটে পড়েন জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার রুকিন্দিপুর ইউনিয়নের মুনইল গ্রামের বিধবা নারী সুফিয়া বেগম। অভাব অনটনের সংসারে নিজ বাড়িতে দু-একটি দেশি হাঁস-মুরগি পালন ও পান-বিড়ি, সিগারেট বিক্রি করে কোনোভাবে সংসার চালাতেন। কিন্তু তারপরও সংসারে অভাব লেগেই থাকত। ঠিক সেই সময়ে বেসরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান জেআরডিএম তার পাশে এসে দাঁড়ায়। এখন তিনি পুরোদস্তুর খামারি। বিদেশি মুরগি নয়, দেশি মুরগির খামার করে ভাগ্য বদলে গেছে তার।
জানা গেছে, জেঁকে বসা অভাব অনটন ঘোচাতে বেসরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান জেআরডিএমের নিকট মুরগি পালনের প্রশিক্ষণ নেন সুফিয়া বেগম। প্রশিক্ষণ শেষ হলে জেআরডিএম প্রতিষ্ঠানটি তাকে বিনামুল্যে ১ হাজার দেশি মুরগির বাচ্চা দেন। তারপর সেই বাচ্চা লালন-পালন করে বাজারে বিক্রি করে অভাব দূর করছেন। আর সেই টাকা দিয়ে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। সেই থেকে শুরু, এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তার খামার থেকে দেশি মুরগির ডিম ও মাংসের মুরগি উৎপাদন করে বাণিজিক্যভাবে বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করেন। এছাড়াও তিনি লাভের টাকা দিয়ে নেটে ঘেরা টিনশেড ঘরে দেশি মুরগি লালন-পালনের ব্যবস্থা করেছেন। এখন তার সেডে ২ হাজারের বেশি মুরগির বাচ্চা আছে।
সুফিয়া বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর সংসারে অভাব আষ্টেপৃষ্ঠে লেগেই থাকে। আর স্বামীর রেখে যাওয়া ছোট্ট একটি দোকান যেখানে পান-বিড়ি ও সিগারেট বিক্রি করে যা আয় রোজগার করতাম, তা দিয়ে দুবেলা খেতেও পারতাম না। ফলে বিভিন্ন ধার-দেনায় ভুবে থাকতাম। তার মধ্যে দুই মেয়ের লেখাপড়ার খরচসহ সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ত। এমন অবস্থায় আমার সংসারের কষ্ট দেখে জেআরডিএমের স্যারেরা আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। পরে তাদের অফিসে নিয়ে যেয়ে প্রশিক্ষণ ও বিনামূল্যে মুরগির বাচ্চা দেন। সেই বাচ্চা লালন পালন করে বাজারে বিক্রি করে সব ধার-দেনা পরিশোধ করে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। তারাও সুখে আছে আমিও সুখে আছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘ব্রয়লার, সোনালি ও কক মুরগি পালনের চেয়ে দেশি মুরগি পালন অনেক সাশ্রয়ী। কারণ দেশি মুরগির খাবারের জন্য চিন্তা করতে হয় না। এই মুরগি বাড়ির উঠানের আশপাশে ঘাস ও পোকামাকড় খেয়ে থাকে। তাছাড়া এ জাতের মুরগির খুব বেশি রোগ হয় না। ফলে আর্থিক ক্ষতির সম্ভবনা কম থাকে এবং লাভ বেশি হয়।’
দেশি মুরগি পালন করে সুফিয়া স্বাবলম্বী হওয়ার বিষয়টি অনুপ্রাণিত করেছেন স্থানীয় নারী ও পুরুষ খামারিদের। শুধু সুফিয়া না, স্বল্প পুঁজি ও নামমাত্র শ্রমে বেশি লাভ হওয়ায় জেলার বেকার যুবক-যুবতী ও নারীরা দেশি মুরগি পালন করছেন। এতে করে বাড়ছে কর্মসংস্থান ও দেশীয় পদ্ধতিতে উন্নত জাতের দেশি মুরগি পালন।
তাদেরই একজন খামারি কামরুজ্জামান জুয়েল। তিনি বলেন, ‘সুফিয়ার এমন সাফল্য দেখে আমিও জেআরডিএম এর কাছ প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশি মুরগি পালন করছি। আগে বিদেশি মুরগি পালন করতাম বেশি পরিমাণে খাবার লাগতো, রোগবালাই লেগেই থাকত আবার বাজারে বিক্রি করেও লাভ হত না। যার কারণে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলাম। এখন দেশি মুরগি পালন করে লোকসান নয় লাভ করতে পারছি।’
জয়পুরহাট জেলা জেআরডিএমের নির্বাহী পরিচালক রাজিয়া সুলতানা বলেন, ‘স্বাদে ও গুণগতমান বেশি হওয়ায় দিন দিন বাড়ছে দেশি মুরগি ও ডিমের চাহিদা। তবে কমে গেছে, দেশি মুরগি পালন। তাই পিকেএসএফের আর্থিক ও জেআরডিএম এর সার্বিক সহযোগিতায় কৃষি সংগঠনের মাধ্যেম সমাজের অবহেলিত নারী পুরুষদের প্রশিক্ষণ ও নতুন উদ্যেক্তা সৃষ্টি করে দেশীয় মুরগি পালনের মাধ্যেমে স্বাবলম্বী করে তোলা হচ্ছে। এছাড়াও তিনি আরো জানান, এ জেলায় তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে মোট ৭৬ জন খামারির মাঝে মুরগির বাচ্চা বিতরণ করা হয়েছে।’
জয়পুরহাট জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মাহফুজার রহমান বলেন, ‘এ জেলায় ছোট বড় প্রায় তিন শতাধিক দেশীয় মুরগির খামারে প্রায় এক লাখ দেশীয় মুরগি লালন-পালন করছে। দেশি মুরগি পালনে উদ্বুদ্ধ করতে সব ধরনের পরামর্শ আমাদের পক্ষ থেকে করা হয়।’
ভোরের আকাশ/আসা