logo
আপডেট : ২৮ জানুয়ারি, ২০২৩ ১৪:১২
বিলুপ্তির পথে গ্রামীণ শিশু-কিশোরদের আকর্ষণীয় মার্বেল খেলা
মামুন হোসাইন, চরফ্যাশন (ভোলা)

বিলুপ্তির পথে গ্রামীণ শিশু-কিশোরদের আকর্ষণীয় মার্বেল খেলা

চরফ্যাশনের মাদ্রাজ গ্রামের মেঠোপথে মার্বেল খেলছে কিশোর বয়সের কিছু ছেলে

মামুন হোসাইন, চরফ্যাশন (ভোলা): সেই হারানো ধুলোমাখা দিন, বুকের ভেতর আজো রঙিন শৈশব ডাকে শুধু আয়, আয়, আয়। নাগরিক কোলাহলে সবাই কুড়িয়ে তোলে শৈশব। সার্বিকভাবে দুরন্তপনা শৈশবের সঙ্গে আজ হারাতে বসেছে আবহমান গ্রামবাংলার বেশকিছু খেলা। এক সময় গ্রামীণ লোকসমাজের শিশুরা পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা করে সময় কাটাত।

 

শৈশবজুড়েই থাকত দুরন্তপনা। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলীন হতে বসেছে বেশকিছু খেলা। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী গোল্লা ছুট, ঘোরাদৌড়, ডাঙ্গুলি, লাঠি খেলা, লাটিম ঘুরানো, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, সাতপাতা, এক্কা-দোক্কা, কুতকুত, মোরগ লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই, ষোলঘুঁটি, রুমাল চুরি, ধাইরাবান্দা, মার্বেল খেলা, লুডু, কাবাডি ইত্যাদি খেলা আজ কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যেতে বসেছে। গ্রামবাংলার খেলাধুলা যেমন হারিয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে হারাচ্ছে শিশুদের মেধাবিকাশের উপকরণ। টিকটক, ইউটিউব , ফ্রি ফায়ার, পাবজিসহ বিভিন্ন ভিডিও গেমসে আটকে যাচ্ছে শৈশব।

 

শৈশব বা কৈশোরে গ্রামবাংলার ছেলেরা মার্বেল দিয়ে নানারকম খেলা খেলেনি, বা দেখেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া নিশ্চয় কঠিন। তবে চির পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে বদলায় সব। কেবল পোশাক, খাদ্য বা ব্যবহার্য জিনিসেই নয়, মানুষের রুচি বদলায় খেলাধুলাতেও। আর এই রুচি বদলের ঢেউয়ে কাটা পড়ছে মার্বেল খেলা।

 

গ্রামবাংলার বেশকিছু খেলার মধ্যে একটি অন্যতম গ্রামীণ আকর্ষণীয় খেলা হচ্ছে মার্বেল খেলা। অভিভাবকদের নিষেধাজ্ঞাই এই খেলার প্রতি কিশোরদের এত বেশি আকর্ষণ করত। এই খেলার নিষ্পত্তি হয় অন্যের মার্বেল খেলে জিতে নিজের করে নেবার মাধ্যমে। গ্রামের মেঠোপথে, বাড়ির আঙিনায় বা উঠানে চলত মার্বেল খেলা। একসময় স্কুল ফাঁকি দিয়ে বা বিকেলে রাস্তার পাশে মার্বেল খেলার কথা অনেক প্রৌঢ়-বৃদ্ধেরই মনে আছে নিশ্চয়ই! মুঠোভর্তি মার্বেল দাগের বাইরে ছুঁড়ে মেরে, নির্দিষ্ট একটি মার্বেল বাদ দিয়ে অন্য যেকোনো একটা মার্বেলে লাগানোর সে কী চেষ্টাই না করত।

 

অনেকেই স্কুল ব্যাগের ভেতর কিংবা হাফপ্যান্টের পকেটে মার্বেল নিয়ে ঘুরত। মার্বেল খেলতে গিয়ে অভিভাবক কিংবা শিক্ষকের বকা খায়নি এমন কাউকে এক সময় খুঁজে পাওয়া মুশকিলই ছিল। স্কুলে টিফিনের ফাঁকে শিক্ষকদের চোখের আড়ালে গিয়েও শিশু-কিশোররা মেতে উঠত মার্বেল খেলায়।

 

সেই আমাদের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বিশেষত শিশু-কিশোরদের অত্যন্ত জনপ্রিয় ও এক সময়ের আকর্ষণীয় মার্বেল খেলা সময়ের স্রোতে সেই খেলা এখন হারিয়ে গেছে।

 

মার্বেল খেলার জন্য কমপক্ষে দুইজন খেলোয়াড় দরকার হয়। তিন, চার, পাঁচ, বা সাতজন মিলেও খেলা যায়। পরিষ্কার সমতল ভ‚মি এই খেলার জন্য উপযোগী।

 

প্রথমে দুটি একটি রেখা টানতে হয়। রেখা থেকে চার-পাঁচ হাত দূরে একটি গর্ত করতে হয় যেন একটি মার্বেল সেই গর্তে বসতে পারে। আঞ্চলিক ভাষায় রেখাটিকে ‘জই’ (কোথাও ‘জল্লা’ নামে পরিচিত) এবং গর্তটিকে ‘কেপ/পিন’ বলে। জইয়ের বাইরে পা রেখে প্রত্যেকে একটি করে মার্বেল কেপ এ ফেলার চেষ্টা করে। যার মার্বেল কেপ এ পড়ে বা সবচেয়ে কাছে যায় সে প্রথম দান পায়।

 

সবাই প্রথম যে দান পায় তার হাতে ২-৩-৪-৫টি করে মার্বেল জমা দেয়। সে মার্বেলগুলো ছকের বাইরে বসে সামনের দিকে ওই গর্তের আশপাশে আলতো করে ছড়িয়ে দেয়। এরপর অন্য খেলোয়াড়রা একটা নির্দিষ্ট মার্বেলকে বলে ‘বাদ’। অর্থাৎ ওই মার্বেল ছাড়া বাকি যেকোনো একটি মার্বেলকে অন্য একটি মার্বেল ছেড়ে দিয়ে স্পর্শ করতে হবে। যদি এমনটা পারে তাহলে ওই দান সে জিতে যায়। আর না পারলে পরবর্তীজন একইভাবে খেলার সুযোগ পায়।

 

তবে ‘বাদ’ দেয়া মার্বেল কিংবা অন্য একাধিক মার্বেলকে ছুড়ে দেয়া মার্বেল স্পর্শ করলে ওই খেলোয়াড়কে ফাইন দিতে হয় এবং দান জেতার জন্য পরবর্তী খেলোয়াড় ফাইন হওয়া মার্বেলসহ সেগুলো ছড়িয়ে দিয়ে খেলতে থাকে। যে কেউ দান জিতলে আবার পুনরায় খেলা শুরু হয়। এভাবেই চলতে থাকে যতক্ষণ না প্রতিপক্ষ আত্মসমর্পণ করে কিংবা প্রতিপক্ষের কাছের মার্বেল শেষ না হয়ে যায়।

 

তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের যুগে ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া লেগেছে শহরের ন্যায় গ্রামেও। মানুষের আর্থিক উন্নতি হচ্ছে, ঝোঁক বাড়ছে পড়াশোনা আর আয়বর্ধক কাজে। খেলার সময় যেমন থাকছেই না শহরের ছেলেদের, তেমনি এখন গ্রামীণ পরিবেশেও খেলার জন্য একটু সময় করা ভীষণ অভাব ছেলেদের।

 

স্মার্টফোন সহজলভ্য হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢু-মেরেই সময়টা পার করতে পছন্দ করে কিশোররা। একা বা জোটবদ্ধ হয়ে সব আড্ডাতেই এখন এই এক বস্তু নিয়েই মাতামাতি। দেশ বিদেশের কোথায় কী ঘটছে, বিনোদন দুনিয়ার সর্বশেষ পরিস্থিতি কী, রাজনীতি, অর্থনীতির হাওয়া কোন দিকে এসব নিয়েই কিশোররা কথা বলে, আড্ডা দেয়।

 

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘গ্রামীণ ক্রীড়াচর্চা’র অভাবে তথা উন্মুক্ত পরিসরে বিচরণ ও খেলাধুলার অভাবে শিশুদের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। শিশুরা এখন ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। ফলে তাদের মানসিক বিকাশ বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। ডিভাইসনির্ভর শিশুরা হারাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের সক্ষমতা।

 

তাদের আপন সামাজিক বলয় বা পরিসর হারিয়ে যাচ্ছে। তারা হয়ে উঠছে একরোখা স্বভাবের। শিশুদের এ দুরবস্থার জন্য মূলত দায়ী তাদের পরিবার। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা তো রয়েছেই। এসবের বলি হচ্ছে শিশুরা। তারা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডের।

 

আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি টিকে রাখা অত্যন্ত জরুরি। তাই, বিলুপ্তপ্রায় খেলাগুলোকে ফিরিয়ে আনা আপনার আমার সবার দায়িত্ব।

 

ভোরের আকাশ/নি