logo
আপডেট : ২৯ জানুয়ারি, ২০২৩ ১১:২৯
হুজির নেতৃত্বে দুর্ধর্ষ জঙ্গি ফখরুল
ইমরান আলী

হুজির নেতৃত্বে দুর্ধর্ষ জঙ্গি ফখরুল

ইমরান আলী: দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে নিষিদ্ধ ঘোষিত ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি)। আফগানিস্তানফেরত দুর্ধর্ষ জঙ্গি ফখরুলের হাত ধরে সংগঠিত হওয়া, সদস্য সংগ্রহ এবং ভয়াবহ হামলার পরিকল্পনা করছিল তারা। ভয়ংকর এই জঙ্গি সংগঠনের একসময়ের শীর্ষ নেতা ছিল মুফতি হান্নান।

 

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় হত্যার উদ্দেশ্যে বোমা পুঁতে এই সংগঠন। জঙ্গি সংগঠনটির শীর্ষ নেতার ফাঁসি কার্যকরসহ অনেক সদস্য আটক হয়ে কারাগারে থাকায় ঝিমিয়ে পড়েছিল বলে মনে করছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। তাদের সে ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে বর্তমানের এ কর্মকান্ড। অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের মতো হুজিও তাদের সদস্য সংগ্রহের জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পের যুবকদের টার্গেট করে। এ জন্য তারা বিপুল অঙ্কের টাকাও দিচ্ছে।

 

নাশকতা চালানোর জন্য এ উপমহাদেশে ব্যাপক পরিচিত জঙ্গি এ সংগঠনটির শীর্ষ নেতাসহ ৬ জন গ্রেপ্তারের পর এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। গ্রেপ্তারকৃত হুজি সদস্যরা হলো মো. ফখরুল ইসলাম (৫৮), মো. সাইফুল ইসলাম (২৪), মো. সুরুজ্জামান (৪৫), হাফেজ মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন (২৩), মো. দীন ইসলাম (২৫) এবং মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন (৪৬)।

 

শনিবার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এ বিষয়ে কথা বলেন সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান।

 

সিটিটিসি জানায়, বিগত ১৯৮৮ সালে দেশ থেকে পাকিস্তান যান মো. ফখরুল ইসলাম। সেখান থেকে তিনি আফগানিস্তানে গিয়ে একে-৪৭, এলএমজি ও রকেট লঞ্চার পরিচালনা করার প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেন ও মোল্লা ওমরের সঙ্গে একাধিকার সাক্ষাৎ করেছে ফখরুল।

 

আরো জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা সিটিটিসির জঙ্গি কার্যক্রমবিরোধী অপারেশন চলমান থাকায় এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের মুফতি হান্নানসহ একাধিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি গ্রেপ্তার হওয়ায় হুজি নেতৃত্বশূন্য হয়ে যায়। তবে ফখরুল ইসলাম দেশে ফিরে হুজির হাল ধরে। সংগঠনটির জন্য সদস্য ও অর্থ সংগ্রহে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে বড় ধরনের জঙ্গি হামলা পরিচালনার বিষয়ে নিজেদের মধ্যে পরিকল্পনা করে আসছিল ফখরুল।

 

সিটিটিসিপ্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ফখরুল ইসলাম ১৯৮৮ সালে গাজীপুর জেলার টঙ্গী থানাধীন তামিরুল মিল্লাত মাদরাসায় দারোয়ানের চাকরি করত। ১৯৮৮ সালে কাজের উদ্দেশে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানের করাচি শহরে যায় সে। পাকিস্তানে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মুফতি জাকির হোসেনের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। সে সময় মুফতি জাকির হোসেন করাচি শহরের ইসলামিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল এবং আল-কায়দার সামরিক কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করত। মুফতি জাকির আল-কায়দা সংগঠনের জিহাদি ট্রেনিংয়ের কমান্ডার।

 

তিনি বলেন, মুফতি জাকির ফখরুল ইসলামকে জিহাদের দাওয়াত দিলে সে দাওয়াত গ্রহণ করে। ফখরুল ইসলাম জিহাদি ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণের জন্য মুফতি জাকিরের সঙ্গে একাধিকার পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানের কান্দাহার শহরে দীর্ঘকালীন প্রশিক্ষণে যায়। ফখরুল ওই ট্রেনিংয়ে বিভিন্ন অস্ত্র প্রশিক্ষণের পাশাপাশি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র একে-৪৭, এলএমজি ও রকেট লঞ্চার পরিচালনার প্রশিক্ষণ নেয়।

 

ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় হুজি নেতা ফখরুল একাধিকার আল-কায়দার নেতা ওসামা বিন লাদেন ও মোল্লা ওমরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। সে আফগানিস্তানে বিভিন্ন মেয়াদে জিহাদি ট্রেনিং করার পর আবার পাকিস্তানের করাচিতে ফিরে আসে। সেখান থেকে ১৯৯৫ সালে ইরানের রাজধানী তেহরান যায় এবং প্রায় ৩ বছর সেখানে থাকার পর আবার করাচিতে ফিরে আসে। পরে ইসলামাবাদ থেকে ভারতের ভিসা নিয়ে ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে চলে আসে।

 

সিটিটিসির এ কর্মকর্তা বলেন, হুজি সদস্যদের বান্দরবান পাহাড়ি এলাকায় প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা করেছিল গ্রেপ্তাররা। ফখরুল ও তার ছেলে মো. সাইফুল ইসলাম অন্যান্য হুজি সদস্যদের নিয়ে একাধিকার কক্সবাজার জেলায় অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যায়। সেখানে রোহিঙ্গাদের মোটা অঙ্কের টাকা অনুদান দেয়।

 

মো. আসাদুজ্জামান বলেন, হুজির একটি এনক্রিপটেড আ্যপের প্রাইভেট চ্যানেল ‘একটু প্রস্তুতির’ কনটেন্ট হিসেবে ‘একটি বোমা তৈরি করো তোমার মায়ের রান্নার ঘরে’ শীর্ষক ১০ পাতার ডকুমেন্ট এবং একই চ্যানেল থেকে টাইমবোমা বানানোর বাংলা বিবরণীসহ ভিডিও শেয়ার করে। আব্দুল্লাহ আল মামুন ওই এনক্রিপটেড অ্যাপসের চ্যানেল থেকে প্রাপ্ত কনটেন্ট তার সংগঠনের পরিচিত দু-একজনকে হাতেকলমে বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ লাভের উদ্দেশে এবং বোমা বানানোর নির্দেশনা দিয়ে শেয়ার করেছে।

 

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তাররা জানায়, তারা টেলিগ্রাম গ্রুপের মাধ্যমে সক্রিয় থেকে উগ্রবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। তাদের অন্যান্য সহযোগী পরস্পরের যোগসাজশে উগ্রবাদী ও আক্রমণাত্মক ভিডিও ও তথ্য শেয়ার এবং নিজেদের মধ্যে গোপন তথ্য আদান-প্রদান করে থাকে। ওই গ্রুপে উগ্রবাদী ও আক্রমণাত্মক প্রশিক্ষণের বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি সচিত্র প্রশিক্ষণ ডকুমেন্টস (পিডিএফ, ভিডিও, অডিও) আদান-প্রদানও করত তারা।

 

এদিকে এর আগেও র‌্যাবের হাতে নতুন জঙ্গি সংগঠন আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার জঙ্গিরা নতুন সদস্য সংগ্রহের জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দিনের পর দিন অবস্থান করে। সেখানেও তারা বিপুল অঙ্কের টাকার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সদস্য সংগ্রহ করে। এক্ষেত্রে হুজিবিও সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে একই পন্থা অবলম্বন করছে।

 

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, নগদ টাকা হাতে পাওয়ার জন্য অনেকেই আবার জঙ্গিতেও নাম জড়াচ্ছে। এমনকি শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগও করছে। সে ক্ষেত্রে অস্ত্র-গোলাবারুদ মজুতের নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে।

 

গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দাবি, টাকা দিলে রোহিঙ্গা যুবকরা ভালোমন্দ বিচার না করে যে কোনো কাজে জড়িয়ে যাবে এবং যাচ্ছেও। বিষয়টি উদ্বেগজনক আখ্যা দিয়ে ক্যাম্পগুলোতে কঠোর নজরদারি চালানোর জন্য সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেন কর্মকর্তারা। এরপরও নানা নাশকতামূলক কর্মকান্ড ঘটছে। বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জঙ্গি তৎপরতা বাড়ছে। বাইরের দেশ থেকেও তাদের নানাভাবে সহায়তা করা হচ্ছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সজাগ রয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/নি