আরিফ সাওন: দুর্নীতির প্রমাণ মিললেও অজ্ঞাত কারণে থেমে আছে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক উত্তম কুমার বড়ুয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। তদন্তে অভিযোগ প্রমানিত হওয়ার পর সোয়া দুই বছরেও তার বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
উত্তম কুমারের বিরুদ্ধে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় সরকারের ৬ কোটি ৪০ লাখ ৩১ হাজার টাকার ক্ষতি সাধনের অভিযোগের প্রমাণ পায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। এরপর নিয়মানুসারে তাকে সাময়িক বরখাস্তের বিষয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। সেই নোটিশ গ্রহণ করে ব্যক্তিগত শুনানি চাইলেও তিনি নির্ধারিত তারিখে হাজির হননি শুনানিতে। এর ১০ মাস পর তাকে দেয়া হয় দ্বিতীয় কারণ দর্শানো নোটিশ। সাত কর্মদিবসের মধ্যে জবাব দিতে দেয়া নোটিশের মেয়াদও পার হয়েছে আরো ১৭ মাস আগে। কিন্তু এখনো উত্তম কুমারের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, উত্তম কুমার বড়ুয়া খুব প্রভাবশালী। যে কারণে তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত আটকে আছে। তাই এ বিষয়ে সহসা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বলে মনে হয় না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার ভোরের আকাশকে বলেন, বিষয়টি এখন কোন অবস্থায় আছে তা জেনে জানাবো।
মন্ত্রণালয়ের তদন্তের বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে অভিযুক্ত অধ্যাপক উত্তম কুমার বড়ুয়া ভোরের আকাশকে বলেন, তদন্তকালে আমার কোনো বক্তব্য শোনা হয়নি।
‘আপনি নাকি ব্যক্তিগত শুনানিতে অনুপস্থিত ছিলেন’ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি তো অসুস্থ থাকতে পারি। আমার অন্য কোনো সমস্যাও থাকতে পারে। আমি এ বিষয়ে কথা বলতে চাই না। এটি একটি রাষ্ট্রীয় প্রসিডিউর। এ বিষয়ে আমি মন্তব্য করতে চাই না। তবে আইনগতভাবে আমার যে অধিকার, তা এখানে সংরক্ষিত হয়নি।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে উত্তম কুমারের বিরুদ্ধে। অভিযোগ ওঠে যে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ক্রয়কারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে হাসপাতালের জন্য ৮টি ওটি লাইট প্রকৃত দামের চেয়ে বেশি দামে কেনেন। তাতে সরকারের ৪ কোটি ৫৯ লাখ ৬৪ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। এ ছাড়া দুটি কোবালেশন মেশিন কিনে ৭৮ লাখ টাকা এবং দুটি অ্যানেসথেশিয়া মেশিন কিনে ১ কোটি ১৭ লাখ ২৫ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি করেছেন। সব মিলিয়ে সরকারের ৬ কোটি ৪০ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এই অভিযোগ পাওয়ার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর ডা. উত্তম কুমারের বক্তব্য জানতে তাকে ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর তৎকালীন স্বাস্থ্য সচিব মো. আবদুল মান্নান নোটিশ দেন। ওই নোটিশে বলা হয়, ‘স্বাস্থ্য বিভাগের প্রাথমকি তদন্তে অভিযোগের সত্যতা প্রমানিত হয়েছে।’ নোটিশে আরো বলা হয়, ‘অসদাচরণ ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হল এবং কেন আপনাকে যথোপযুক্ত দণ্ড প্রদান করা হবে না, সে বিষয়ে নোটিশ প্রাপ্তির ১০ কর্মদিবসের মধ্যে নিম্ন স্বাক্ষরকারীর নিকট কারণ দর্শানোর জন্য নির্দেশ প্রদান করা হল। একই সঙ্গে আপনি ব্যক্তিগত শুনানি চান কিনা, তাও জানতে নির্দেশ প্রদান করা হল।’ এই নোটিশ গ্রহণ করে ব্যক্তিগত শুনানি চেয়ে আবেদন করেন ডা. উত্তম কুমার। এই আবেদন গ্রহণ করে তাকে শুনানিতে হাজির থাকতে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু নির্ধারিত দিনে তিনি শুনানিতে হাজির হননি। এর ১০ মাস পর ২০২১ সালের ২৬ আগস্ট তাকে দ্বিতীয়দফা কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তৎকালীন সিনিয়র সচিব লোকমান হোসেন মিয়া স্বাক্ষরিত দ্বিতীয় নোটিশে বলা হয়েছে- ‘যেহেতু আপনি উক্ত কারণ দর্শানোর নোটিশ গ্রহণ করেছেন এবং ব্যক্তিগত শুনানি প্রার্থনা করলেও নির্ধারিত তারিখে ব্যক্তিগত শুনানিতে অনুপস্থিত ছিলেন; এবং যেহেতু আপনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত করার জন্য সরকাারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা-আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর বিধি অনুযায়ী গঠিত তদন্ত কমিটি অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন এবং তদন্তে আপনার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। সেহেতু আপনার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর বিধি ৩(খ) ও ৩(ঘ) মোতাবেক অসদাচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হওয়ায় একই বিধিমালার বিধি ৪(৩)(ঘ) অনুযায়ী আপনাকে কেনো চাকরি হতে বরখাস্ত করা হবে না, সেবিষয়ে পত্র প্রাপ্তির সাত কর্মদিবসের মধ্যে নিম্নস্বাক্ষরকারীকে লিখিতভাবে জানানোর জন্য অনুরোধ করা হল।’
জানা যায়, দ্বিতীয় নোটিশ দেয়ার পরও ডা. উত্তম কুমার শুনানিতে অংশ নেননি। এরইমধ্যে দ্বিতীয় নোটিশের মেয়াদও অতিবাহিত হয়েছে ১৭ মাস। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।
ভোরের আকাশ/আসা