logo
আপডেট : ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ১৩:৪১
লক্ষীপুরে ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় বিপন্ন জীবন
লক্ষীপুর প্রতিনিধি

লক্ষীপুরে ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় বিপন্ন জীবন

লক্ষীপুরের রামগতি উপজেলার একটি ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো হচ্ছে

লক্ষীপুরের রামগতি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ার প্রভাবে বিপন্ন বিস্তীর্ণ জনপদের মানুষের জীবন। বিষিয়ে উঠছে তাদের জীবনযাত্রা ও স্বাভাবিক বসবাস। নানা জটিল রোগে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে এলাকার শিশুসহ নানা বয়সি লোকজন।

 

দেদার এসব ইটভাটায় প্রকাশ্যে কাঠ পোড়ানো হলেও কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় একদিকে এলাকার বনজ সম্পদ কমে আসছে অন্যদিকে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে মারাত্মকভাবে। এলাকাবাসী এসব ইটভাটার বিরূদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন।

 

জানা যায়, লক্ষীপুরের রামগতি উপজেলার আয়তন ৩৪৭ বর্গকিলোমিটার। এ স্থল আয়তনের তিন ভাগের একভাগ ইতিমধ্যে মেঘনা গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আটটি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এ উপজেলা।

 

এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, এখানে সর্বমোট বত্রিশটি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি বন্ধ হয়ে হয়ে গেছে। ৭নং চররমিজ ইউনিয়নেই রয়েছে ১৪টি ইটভাটা।

 

এসব ইটভাটার সবটিতেই পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। কোনোটিরই নেই সঠিক অনুমোদন কিংবা বৈধ কাগজপত্র। স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন পক্ষকে ম্যানেজ করেই চলছে এসব ভাটার ইট পোড়ানোর কাজ। ভাটাগুলোর মালিকদের মধ্যে রয়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা ও স্থানীয় একশ্রেণির প্রভাবশালী। কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই প্রতি বছরই কোনো না কোনো ইউনিয়নের ফসলি জমিতে গড়ে উঠছে এসব ভাটা।

 

এদিকে কৃষি যন্ত্রপাতির ক্রয়ের ভর্তুকির সরকারি সুবিধা নিয়ে কেনা প্রায় দুই শতাধিক অবৈধ ট্রাক্টর ট্রলি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো উপজেলা, ক্ষত-বিক্ষত করছে গ্রামীণ কাঁচা, পাকা ও আধাপাকা সড়ক।

 

অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর সচেতন এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে একাধিক লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হলেও প্রশাসনের অভিযান কিংবা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। বেপরোয়া ইটভাটাগুলোর মালিকপক্ষ। ইটভাটা তৈরিতে একদিকে যেমন কৃষিজমি ধ্বংস করা হচ্ছে অন্যদিকে দখল করা হচ্ছে সরকারি খাল, নদী ও খাসজমি। এসব ভাটায় যানবাহন যাতায়াতে তৈরি করা হচ্ছে অবৈধ সড়ক। জনপ্রতিনিধিরা যুক্ত থাকায় খাল-নদী দখল করে দেয়া হচ্ছে রাস্তা তৈরির প্রকল্প।

 

অপরদিকে নির্বিচারে কাঠ পোড়ানোয় ধ্বংস হচ্ছে দেশি-বিদেশি নানা প্রজাতির গাছগাছালি। ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি ‘টপসয়েল’ বিক্রিতে হ্রাস পাচ্ছে জমির উর্বরা শক্তি। এ ছাড়া প্রায় প্রতিটি ভাটাতেই শ্রমিক হিসেবে যুক্ত আছে শিশু শ্রমিক। ভাটা মালিকদের বিরুদ্ধে আছে মামলা হামলার অভিযোগও।

 

ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি মো. ইব্রাহিম খলিলের বিরুদ্ধে আছে শ্রমিক নির্যাতনের একাধিক অভিযোগ। একই অভিযোগ আছে সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছানা উল্যাহর বিরুদ্ধেও। মেসার্স মোহাম্মদীয়া ব্রিকসের স্বত্বাধিকারী লিটনের বিরুদ্ধে আছে ব্যবসায়িক পার্টনার রহিমকে হামলা মামলা ও অত্যাচার করে এলাকা ছাড়া করার অভিযোগ। কোটি টাকার চেক প্রতারণায় মামলায় জেলও খেটেছে এ ইটভাটা মালিক। মেসার্স আবু ব্রিকসের মালিক মো. আলমগীর হোসেন (আবু ব্যাপারির) নিজ মালিকানাধীন একটিসহ দুই পুত্রের নামে আছে দুটি ইভটাটা।

 

সরেজমিন জানা যায়, এসব অবৈধ ইটভাটার মধ্যে রয়েছে ফাতেমা নাজ-আফরা ব্রিকস, মেসার্স তৃষা ব্রিকস লাইন, মেসার্স ফারদিন আনাম ব্রিকস, এমএস ব্রিকস, শাওন সোহান ব্রিকস, মেসার্স আমরি ব্রিকস, মেসার্স এআর ব্রিকস, মেসার্স বাঘা ব্রিকস, মেসার্স আবু ব্রিকস, মেসার্স নুরুল আলম ব্রিকস, মেসার্স শাহপরান ব্রিকস, মেসার্স শরাফত আলী ব্রিকস, মেসার্স বিসমিল্লাহ ব্রিকস, মেসার্স মোহাম্মদীয়া ব্রিকস, মেসার্স আল্লার দান ব্রিকস।

 

ররমিজ ইউপি চেয়ারম্যান মোজাহিদুল ইসলাম দিদারের নামে একটি, চরআলগী ইউপি সদস্য আবুল কালামের স্বনামে একটি এবং যৌথ মালিকানায় একটি ইটভাটা রয়েছে। এ ইউপি সদস্য আবুল কালামের বিরুদ্ধে আছে ভুলুয়া নদী ও সরকারি খাসজমি দখলের। এ ছাড়াও প্রায় প্রতিবছর তার মালিকানাধীন ইটভাটায় অবৈধভাবে ভুলুয়া নদী খনন করে মাটি ব্যবহারের অভিযোগও।

 

এলাকাবাসী জানান, ইটভাটা মালিকদের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কাছে উপজেলা প্রশাসন যেন অসহায়। অভিযান চালিয়ে চিমনি ভেঙে আগুন নিভিয়ে দেয়ার পরও পুনরায় চালু হচ্ছে ভাটার আগুন। গত বছরের ডিসেম্বরে উপজেলার ১১টি অবৈধ ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে চিমনি ভেঙে আগুন নিভিয়ে দেয়াসহ সাড়ে ৯ লাখ টাকা জরিমানা ও একজনকে কারাদন্ডা দেশ দেন উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেডের ভ্রাম্যমাণ আদালত।

 

এ ছাড়াও প্রায়ই এসব ইটভাটায় বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এতকিছুর পরও ইটভাটা বন্ধ করা যাচ্ছে না অদৃশ্য কারণে। সচেতন এলাকাবাসী এসব অবৈধ ইটভাটা স্থায়ীভাবে বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতনের হস্তক্ষেপ দাবি করছেন।

 

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম শান্তুনু চৌধুরী জানান, পরিবেশ রক্ষা ও জনস্বার্থ বিবেচনা করে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।

 

ভোরের আকাশ/নি