প্লাবন শুভ, ফুলবাড়ী (দিনাজপুর): কালের যাত্রায় শতবর্ষ মোটেও কম সময় নয়। ১৯২০ সালে যাত্রার যে চাকাটি ঘুরতে শুরু করেছিল ২০২০ সালে সে চাকাটি শতবর্ষের স্পর্শ রেখে যাচ্ছে। এ চাকা আরো কত নিরবধিকাল বয়ে চলবে, তা ভবিষ্যৎ জানে। ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার গোলাম মোস্তফা (জিএম) পাইলচ উচ্চ বিদ্যালয়টি।
করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে ২০২০ সালে শতবর্ষের আয়োজন করতে না পারলেও ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়টি আজ শনিবার শতবর্ষ উৎসব পালন করছে। এ উপলক্ষে দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য আয়োজনে উৎসবটি স্মৃতিজাগানিয়া হয়ে উঠেছে সতীর্থদের পদচারণায়। বিদ্যালয়ের টানে, বন্ধুদের টানে, প্রাণের টানে স্মৃতি জাগনি বিনিদ্র করতে দেশ-দেশান্তর থেকে ছুঁটে এসেছেন প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। আজ প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ।
ফুলবাড়ী পৌর শহরের ঢাকা মোড় এলাকায় ১০ একর জমিতে অসম্ভব সুন্দর পুকুরের পাশাপাশি গাছ-গাছালির ছায়া ঘেরা, পাখি ডাকা নয়নাভিরাম পরিবেশে বিদ্যালয়টির অবস্থান। জানা যায়, ভারতের হুগলী জেলার বাসিন্দা সৈয়দ গোলাম মোস্তফা। পেশায় এমবিবিএস চিকিৎসক। তিনি ১৯১৯ সালের পূর্বে এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচার ও সেবার জন্য আসেন।
সেই সময় ফুলবাড়ীসহ আশপাশের লোকজনের সেবা দিতে গিয়ে তাদের জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করার লক্ষ্যে ফুলবাড়ী রেলস্টেশনের ঢাকামোড় নামক স্থানে তারই নামে গোলাম মোস্তাফা উচ্চ মাদরাসা স্থাপন করেন। যা বর্তমানে গোলাম মোস্তফা (জিএম) পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত।
আজ শনিবার মূল উৎসব হলেও গত বৃহস্পতিবার থেকেই বিভিন্ন বয়সি নারী-পুরুষের পদচারণায় মুখোর ছিল পুরো বিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সবাই উপভোগ করছেন ব্যয়বহুল সাজ-সজ্জায়। এ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা সমাজের বহুদিক আলোকিত করেছেন। রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসাবিদ্যা, রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের গৌরবোজ্জ্বল উপস্থিতি। এই কীর্তিমান মানুষগুলো ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে কত বিখ্যাতজনের শৈশবের স্মৃতিজড়িত এই বিদ্যালয়। অগণিত নাম যুক্ত হয়ে আছে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে। এ বিদ্যালয়ের কৃতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডক্টরেট, সচিব, চিকিৎসক, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিকসহ উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এ বিদ্যালয়টির গৌরবকে উজ্জ্বল করেছেন। এতসব গৌরবোজ্জ্বল কীর্তিমান মানুষ গড়ার নেপথ্য কারিগরের নাম গোলাম মোস্তাফা। আরেকজন মানুষ গড়ার কারিগর হলেন বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার প্রথম প্রধান শিক্ষক শরৎ চন্দ্র সরকার।
শতবর্ষ উদযাপনের জন্য বিদ্যালয়টির প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও বর্তমান বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আতাউর রহমান মিল্টনকে আহব্বায়ক এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থী পৌর মেয়র মাহমুদ আলম লিটনকে সদস্য সচিব করে শতবর্ষ উদযাপন কমিটি করা হয়। গোলাম মোস্তাফা (জিএম) পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে আজ শনিবার দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে।
এ উপলক্ষে পুরো বিদ্যালয়কে সাজানো হয়েছে চোখ ধাঁধাঁনো আলোক সজ্জায়। বিদ্যালয় চত্বর জুড়ে আছে নানা রকম ফেস্টুন-ব্যানারসহ সেলফি গ্যালারি। বিদ্যালয়ের প্রবেশ দ্বারে বানানো হয়েছে একটি সুসজ্জি ফটক। ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে সুদৃশ্য একটি শতবর্ষের স্মৃতিস্তম্ভ। আজ সকাল ৮টায় রেজিস্ট্রেশন, বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, স্মৃতিচারণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ মনোজ্ঞ নানা অনুষ্ঠানে হৈহুল্লোড় করে উৎসব আনন্দে দিন পার করবে বিদ্যালয়ের বর্তমান এবং সাবেক শিক্ষার্থীরা।
শতবর্ষপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিম মাহমুদ চৌধুরী এমপি। অনুষ্ঠানে উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি, দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার এমপি। এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. এম কামরুজ্জামান, দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. কামরুল ইসলাম প্রমুখ।
বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম, আরিয়ান বাবুসহ বেশ কিছু বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, বিদ্যালয়ে শতবর্ষ দেখতে পাওয়া আসলেই ভাগ্যের বিষয়। আমরা এই ইতিহাসের স্বাক্ষী হতে পারছি, এটার চেয়ে বড় গর্ব আর কিসে।
বিদ্যালয়টির প্রাক্তন শিক্ষার্থী দৈনিক ভোরের আকাশের প্রকাশক এসএম আব্দুল্যাহ নুরুজ্জামান বলেন, এ উৎসব অবশ্যই আনন্দের ও ইতিবাচক। শতবর্ষ উৎসবের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের গৌরবময় ঐতিহ্য নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে আর্থসামাজিক অগ্রগতির প্রেরণা হবে নতুনদের কাছে। আজ আমরা সাতাষিয়ান ব্যাচের বন্ধুরা পরিবার-পরিজন নিয়ে একত্রিত হয়েছি।
কেউ কেউ আছি টগবগে যুবকের মতো আবার কেউ কেউ বৃদ্ধের মতো নুয়ে পড়েছি। দীর্ঘদিন পর এই মিলনমেলা সত্যি অনেক আনন্দের। যা বলে প্রকাশ করার মতো না। আজ আমাদের বন্ধুদের এই মিলনমেলা যেনো স্বর্গকে ছুঁয়েছে। অনেক হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যদিয়ে আজ পালন করা হচ্ছে মহা অপেক্ষার এ শতবর্ষ উৎসবটি।
বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক বিরেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, গত এক শতাব্দীতে বিদ্যালয়টি বহু কীর্তিমান শিক্ষার্থীর জন্ম দিয়েছে। ১৯৭১ সালে বিদ্যালয়টিতে পাকবাহিনী ক্যাম্প করে, ওই সময় তারা বিদ্যালয়ের রেকর্ডপত্র নষ্ট করে চলে যায়। তাই বিদ্যালয়ের অনেক ইতিহাস আজ অজানা। তিনি বলেন, ১৯২০ সালে গোলাম মোস্তফা হাই মাদরাসা হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
পরবর্তী সময় ১৯৫৮ সালে এটি জিএম উচ্চ বিদ্যালয়ে রূপান্তর হয়। শুরুতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন শরৎ চন্দ্র সরকার। তারপর থেকে ৭ জন প্রধান শিক্ষকের পদচারণার পর বর্তমানে মো. মোজাম্মেল হক প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন।
বর্তমান প্রধান শিক্ষক মো. মোজাম্মেল হক বলেন, শতবর্ষের উৎসবকে আগামী প্রজন্মের কাছে স্মৃতিবহ করে রাখতে স্মরণিকা প্রকাশসহ ব্যতিক্রমী সব আয়োজন করা হয়েছে। বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে হাজারো শিক্ষার্থীসহ ৩২ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়ে বিদ্যালয়টি শিক্ষাদান করে যাচ্ছে। নিভৃত পল্লী এলাকার শতবর্ষে সমৃদ্ধ এই বিদ্যালয়টি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরিতে অনন্য ভ‚মিকা রেখেছে। বাংলাদেশের অনেক প্রথিতযশা গুণী ব্যক্তিত্ব এই বিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শুরু করেছেন।
শতবর্ষ উদযাপন কমিটির আহব্বায়ক ও বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আতাউর রহমান মিল্টন বলেন, শতবর্ষ উৎসবের আমেজ ঘিরে চার থেকে পাঁচ হাজার মানুষের মিলনমেলা হবে। সুদূর আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে থেকে ছুটে আসছেন বিদ্যালয়টির প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। উৎসবকে স্মরণিয় করে রাখতে বিভিন্ন ব্যাচের প্রাক্তন ছাত্ররা নানা রকম আয়োজনে নিজেদের উচ্ছাস প্রকাশে মেতে উঠেছেন। ব্যানার-ফেস্টুন আর আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়েছে পুরো বিদ্যালয় চত্বর।
তিনি আরো বলেন, বিদ্যালয়টি ১৯৬৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত অধ্যয়নরত বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা শতবর্ষ অনুষ্ঠানের জন্য রেজিস্টেশন করেছে। শতবর্ষ উদযাপনের মধ্যদিয়ে বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের এক মহামিলন মেলায় পরিণত হবে আমাদের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অনুষ্ঠানটি সকল শিক্ষার্থীদের জীবনে স্মৃতি হয়ে থাকবে।
ভোরের আকাশ/নি