logo
আপডেট : ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ১৩:৪৩
অসচেতনতায় ঝুঁকিতে নিরাপদ নারী স্বাস্থ্য
১৪% মাতৃমৃত্যু অনিরাপদ গর্ভপাত
নিখিল মানখিন

১৪%  মাতৃমৃত্যু অনিরাপদ গর্ভপাত

নিখিল মানখিন: অসচেতনতায় ব্যাহত হচ্ছে নিরাপদ নারী স্বাস্থ্য কর্মসূচি। দেশে মোট মাতৃমৃত্যুর ৭৩ শতাংশই ঘটে প্রসব-পরবর্তী সময়ে। যাদের ৫৬ ভাগই মারা যায় প্রসবের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা কারণে নিরাপদ নারী স্বাস্থ্য অনেকটা ঝুঁকির মধ্যে রয়ে গেছে। বাল্যবিয়ের হার খুব বেশি কমেনি।

 

গত দশ বছরে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহারকারীর হার বৃদ্ধি হলেও স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতিতে তেমন কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। মোট মাতৃমৃত্যুর ৫৩ ভাগই ঘটে থাকে বাড়িতে প্রসবের কারণে। আর দেশে ইচ্ছার বিরুদ্ধে গর্ভধারণের কারণে গর্ভপাতের মাত্রা বেড়েই চলেছে।

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বাংলাদেশে ১৪ শতাংশ মাতৃমৃত্যুর কারণ অনিরাপদ গর্ভপাত। অপরিকল্পিত এই গর্ভধারণ ও গর্ভপাতের পুরো ঝুঁকি পোহাতে হয় নারীকে। আর দেশে প্রসব-পরবর্তী পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণের হারও সন্তোষজনক নয়। ফলে নিরাপদ নারী স্বাস্থ্য অনেকটা ঝুঁকির মধ্যে রয়ে গেছে।

 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর পরিকল্পিত পরিবার গঠনের লক্ষ্যে পরিবার পরিকল্পনা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য, বয়ঃসন্ধিকালীন, প্রজনন স্বাস্থ্য, নিরাপদ মাতৃত্ব, জেন্ডারবিষয়ক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। কিন্তু মা ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস পেলেও অপরিকল্পিত গর্ভধারণ ও গর্ভপাত সমস্যা কমছে না। এর পাশাপাশি বর্তমান তরুণ-তরুণীরা গোপন মিলনে জড়িয়ে পড়ছে এবং এতে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ ও গর্ভপাতের ঘটনাও বেড়েছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অল্প বয়সে বিয়ে হলেও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করলে ৩২ শতাংশেরও বেশি মাতৃমৃত্যু রোধ করা সম্ভব। নিরাপদ মাতৃত্ব নিয়ে কাজ করে ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানড পেরেন্টহুড ফেডারেশন। এই আন্তর্জাতিক এনজিওটির কাগজপত্র বলছে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৪০ লাখ নারী গর্ভধারণ করেন। তাদের মধ্যে ১৩ লাখই থাকেন অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ।

 

পরিবার-পরিকল্পনা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির সঠিক ব্যবহার না জানা, পদ্ধতির স্বল্পতাই অপরিকল্পিত গর্ভধারণের মূল কারণ। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির অধিকাংশই নারীর ব্যবহারের জন্য। স্থায়ী পদ্ধতি ছাড়া পুরুষের ব্যবহারের জন্য কনডমই একমাত্র পদ্ধতি। পরিবার-পরিকল্পনাকর্মীরা বলছেন, নারীর তুলনায় কমসংখ্যক পুরুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এনজিও মেরী স্টোপস প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা দেয়।

 

এনজিওটির কর্মকর্তারা আরো বলেন, অনিরাপদ গর্ভপাতের পর ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, জরায়ু, মূত্রনালি এবং অন্ত্রনালি ছিদ্র হয়ে যাওয়া, প্রস্রাব ও পায়খানার রাস্তা ছিঁড়ে এক হয়ে যাওয়া, বন্ধ্যত্বের শিকার হওয়াসহ বিভিন্ন জটিলতার সম্মুখীন হন নারীরা।

 

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রিভেনশন অব সেপটিক অ্যাবরশনের পরিচালক আলতাফ হোসেন বলেন, অনাকাক্সিক্ষত সন্তান না রাখতে চাইলে তার পথও খোলা আছে। নারীর শেষ মাসিকের প্রথম দিন হিসাবে ৬ থেকে ১০ সপ্তাহের মধ্যে এমআর বা মাসিক নিয়মিত করার পদ্ধতি (যেকোনো কারণে মাসিক বন্ধ থাকলে তা নিয়মিত করে দেয়া) বৈধ। তিনি বলেন, অনেক স্বামী নিজে সচেতন না হয়ে নিরাপদ ব্যবস্থা হিসেবে এমআরকেই বেছে নেন। এটা যে স্ত্রীর শারীরিক ক্ষতির কারণ, তা আমলে নেন না।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের অধ্যাপক নার্গিস আকতার বলেন, শারীরিক কারণে অনেক নারী স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন না। তাদের স্বামীরাও কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করেন না। তাই কোনো কোনো নারীকে দুই-তিনবার পর্যন্ত এমআর করে দিতে হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, দেশে বহুবিয়ের প্রবণতা বেশি। এছাড়া অনৈতিক সম্পর্ক করারও ঝুঁকি আছে। তাই একজন পুরুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করলে অনেক ক্ষেত্রে একাধিক নারী অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণের হাত থেকে রেহাই পেতে পারেন।

 

অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণের কুফল সম্পর্কে গণমাধ্যমে প্রচার বাড়ানো জরুরি। পাশাপাশি পদ্ধতি গ্রহণের ক্ষেত্রে পুরুষের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা দরকার বলে মনে করেন অধ্যাপক নার্গিস আকতার ।

 

বিশেষজ্ঞরা বলেন, গত দশ বছরে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহারকারীর হার বৃদ্ধি হলেও স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতিতে তেমন কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। অথচ স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ ছোট পরিবার গঠনের অন্যতম পূর্বশর্ত। দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণের হার বৃদ্ধির জন্য সক্ষম দম্পতি তথা জনগণকে বিভিন্ন তথ্য ও সেবা প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যার মধ্যে প্রসব-পরবর্তী পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ উল্লেখযোগ্য।

 

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৩.১ মিলিয়ন (৩১ লাখ) প্রসব সংঘটিত হয়, যার প্রায় ৩৭.৪ শতাংশ (১১ লাখ) প্রসব হয় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের পরপরই মাকে যদি প্রসব-পরবর্তী পরিবার পরিকল্পনার আওতায় আনা যায়, তাহলে একদিকে যেমন অনিচ্ছাকৃত ও পুনরায় গর্ভধারণ এড়ানো সম্ভব, তেমনি দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী পদ্ধতি বিশেষ করে টিউবেকটমি ও আইইউডি গ্রহীতা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করা সম্ভব।

 

সক্ষম দম্পতিদের ক্ষেত্রে দুই সন্তানের মাঝে ন্যূনতম (৩ বছর) বিরতি এবং দুটি জীবিত সন্তানের ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টির বয়স কমপক্ষে ১ বছর হলে স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করাই এবারের সেবা ও প্রচার সপ্তাহের মূল লক্ষ্য। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির গ্রহীতা বৃদ্ধি মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাসে সরাসরি প্রভাব রাখতে সক্ষম। সরকারের এ প্রচেষ্টার পাশাপাশি গণমাধ্যমের সক্রিয় সহযোগিতা করা দরকার। প্রসবের পর প্রথম ১২ মাসের মধ্যে অনিচ্ছাকৃত ও স্বল্প বিরতিতে পুনরায় গর্ভধারণ হতে বিরত থাকাই হলো প্রসব-পরবর্তী পরিবার পরিকল্পনা।

 

এর কৌশলগত দিক হলো প্রসবের পর উপযুক্ত পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ অথবা দুটি সন্তান জন্মদানের মধ্যবর্তী সময়ে একজন নারীর ইচ্ছানুযায়ী প্রয়োজনীয় বিরতি প্রদান (কমপক্ষে ৩ বছর) অথবা সন্তান জন্মদানে সীমিতকরণ।

 

এদিকে, দেশে গর্ভবতী মায়ের মৃত্যুসংখ্যা আগের তুলনায় কমেছে বলে তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ ম্যাটারনাল মর্টালিটি অ্যান্ড হেলথ কেয়ার সার্ভে (বিএমএমএস)। তাদের তথ্যানুযায়ী, ৯০-এর দশকে প্রতি এক লাখ জীবিত শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ৫৭৪ জন সন্তানসম্ভবা নারীর মৃত্যু হতো। যা কমে প্রতি লাখে ১৬৫ জনে দাঁড়িয়েছে। সে হিসাবে ৯০-এর দশকের তুলনায় মাতৃমৃত্যু ৭০ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে।

 

তবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী, সরকার মাতৃমৃত্যু হার লাখে ৭০ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। জাতীয় মাতৃস্বাস্থ্য কৌশলপত্র অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব ৪৭ দশমিক এক শতাংশ থেকে ৮৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। দক্ষ ধাত্রীর মাধ্যমে প্রসবের হার ৫০ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে।

 

পাশাপাশি মাতৃমৃত্যুর হার এবং নবজাতকের মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে হবে। গর্ভকালীন সময়ে কমপক্ষে ৪ বার গর্ভকালীন সেবা গ্রহণের হার ৩৭ দশমিক ২ শতাংশ থেকে শতভাগে উন্নীত করতে হবে। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ সে লক্ষ্য অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করেছে।

 

বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কাজী আ খ ম মহিউল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, দেশে মোট মাতৃমৃত্যুর ৭৩ শতাংশই ঘটে প্রসব-পরবর্তী সময়ে। যাদের ৫৬ ভাগই মারা যায় প্রসবের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। এসব মাতৃমৃত্যুর ৩১ শতাংশই ঘটে রক্তক্ষরণের কারণে। ২৪ ভাগ মৃত্যুর জন্য দায়ী খিঁচুনি বা একলাম্পশিয়া।

 

এছাড়া ৩ শতাংশ মায়ের মৃত্যু ঘটে বাধাগ্রস্ত বা অবিরাম প্রসব ব্যথার কারণে। মোট মাতৃমৃত্যুর ৫৩ ভাগই ঘটে থাকে বাড়িতে প্রসবের কারণে। তাই বাড়িতে প্রসবকালীন জটিলতা দেখা দিলে দ্রæত ক্লিনিক ও হাসপাতালে নিতে হবে।

 

ভোরের আকাশ/নি