মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: ফররুখ আহমদের ‘ফাল্গুনে শুরু হয় গুন-গুনানি’ কিংবা মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার ‘হিম কুহেলির অন্তর তলে আজিকে পুলক জাগে’ এমন সব গান কবিতার লাইন মনে এলে আমরা বসন্তকে অনুভব করতে পারি। কবিগুরুর ‘আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে’, সুফিয়া কমালের ‘বাতাবি নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?’ এসব লাইন মনে এলেই আমরা বসন্তকে অনুভব করি।
অনুভব মনের ব্যাপার। মনের বসন্ত অন্য বিষয়। এটা ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হয়। সকালে মনে বসন্তের মাতাল সমীরণ তো বিকালে ভর শ্রাবণ। কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে ভিন্নরূপে। এটি একটি নিদিষ্ট সময় স্থায়ী হয়। বদলে যায় প্রকৃতি।
আজ বসন্তের শুরু। বসন্ত মানেই প্রকৃতিতে নানা উৎসব বর্ণিল উৎসবের আয়োজন। চারদিকে নতুন পাতা নতুন ফুল নতুন রঙ, নব নতুন ঘ্রাণের ঝংকার। বৃক্ষগুলো নবসাজে সজ্জিত হয়ে ওঠে। নতুন করে গেয়ে ওঠে পাখিরাও। প্রকৃতি এক অপার রহস্যে জেগে থাকে চিরদিন।
এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মাঝেও ভর করে ঋতুরাজ বসন্ত। গাছে গাছে সবুজ পাতা আর নানা রঙের ফুল। শিমুল, পলাশ আর কৃষ্ণচ‚ড়ারা সাজে সূর্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রক্তিম রঙে। কোকিল গান ধরে ভ্রমরের গুন-গুনানির তালে তালে।
চারদিকে শোনা যায় ঝরার ধ্বনি। বিশ্ব জুড়ে এখনো করোনার তান্ডব চললেও এবারো বসন্ত ঠিকই তার পূর্বের রূপে ফিরে এসেছে। বসন্ত ঋতু লুকিয়ে আছে ফাল্গুন ও চৈত্র মাসের ভেতর। বসন্তের প্রথম মাসটি বাঙালিদের জন্য বড় আবেগের, বড্ড ভালোবাসার। এ মাসেই আমরা নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার পায়। মাসটি আবার আমাদের জন্য বেদনারও।
কারণ এ মাসে বাংলা ভাষার দাবিতে প্রাণ দেন সালাম, বরকত শফিকরা। ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ৮ ফাল্গুন ঘটেছিল মহান ভাষা আন্দোলন, যা আজ বিশ্বব্যাপী ২১ ফেব্রুয়ারির মোড়কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
প্রতিবারের মতো সেজেছে ঋতুরাজ। দখিনা হাওয়া, মৌমাছিদের গুঞ্জরণ, কচি-কিশলয় আর কোকিলের কুহুতানে জেগে ওঠার দিন আজ। গীতিকবির ভাষায় এ বসন্তে না গেয়ে গান থাকতে পারি কি। লাল আর বাসন্তী রঙে প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের সাজিয়ে আজ বসন্তের উচ্ছলতা ও উন্মাদনায় ভাসবে বাঙালি। বসন্ত অনেক ফুলের বাহারে সজ্জিত হলেও গাঁদা ফুলের রংকেই এদিনে তাদের পোশাকে ধারণ করে তরুণ-তরুণীরা।
খোঁপায় শোভা পায় গাঁদা ফুলের মালা। বসন্তের আনন্দযজ্ঞ থেকে বাদ যাবে না গ্রামীণ জীবনও। বসন্তের বন্দনা আছে কবিতা, গান, নৃত্য আর চিত্রকলায়। সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনেও বসন্ত ঠাঁই করে নিয়েছে তার আপন মহিমায়। শুধু আমাদের দেশে নয় ঋতু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এ বসন্ত ঋতু তথা ফাল্গুন মাসে দক্ষিণ এশীয় নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানেই এ সময়টি আশীর্বাদ রূপে আসে।
এ সময়টা বিশ্ব এর বিভিন্ন অঞ্চলে মৃদু মানের বর্ষা হয় যার ফলে সেসব স্থানে বৃক্ষরা পত্রপল্লবে নিজেদের জানান দেয়। অন্যদিকে হিমাচল প্রদেশসহ কাশ্মীর অঞ্চলের তুষারপাত ক্রমে কমে আসে এবং মানুষ তাদের স্বাভাবিক কাজকর্মের ভরসা পেতে থাকে।
প্রতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় আয়োজন করা হয় বসন্ত উৎসব। এদিন চারুকলা থেকে শুরু হয়ে এ উৎসব ছড়িয়ে পড়ে ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চ, ল²ীবাজারের বাহাদুর শাহ পার্ক এবং উত্তরার ৩নং সেক্টরের রবীন্দ্র সরণির উন্মুক্ত মঞ্চে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে বসন্ত বরনের আযোজন করা হয়।
গত বসন্ত ছিল এদেশের মানুষের অস্থিরতার সময়। করোনার ছোবলে থমকে গিয়েছিল সবকিছু। বসন্ত মানেই যেখানে নতুন প্রাণের কলরব, সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা অনেকটায় মøান করে দিয়েছিল। এবারো পরিস্থিতি পুরাপুরি অনুক‚লে না আসলেও অন্যরকম বসন্ত উদযাপনের অপেক্ষায় আছে বাঙালি মন।
এ দিনে বর্ণিল পোশাক আর ফুলের বর্ণচ্ছটা গায়ে মাখিয়ে তরুণ-তরুণীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, চারুকলার বকুলতলা, বইমেলাসহ সারা দেশ মাতিয়ে রাখবে। সবার মনে যেন একটিই বাণী আহা আজি এ বসন্তে অথবা বসন্তের এ মাতাল সমীরণে।
ভোরের আকাশ/নি