logo
আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ১০:৫৫
অপরিকল্পিত আবাসনে বিপর্যস্ত পরিবেশ-১
পাহাড়কাটা ও দখল-দূষণে বিবর্ণ কক্সবাজার
এইচ এম ফরিদুল আলম শাহীন, কক্সবাজার

পাহাড়কাটা ও দখল-দূষণে বিবর্ণ কক্সবাজার

এইচ এম ফরিদুল আলম শাহীন, কক্সবাজার: কক্সবাজার ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অপরিকল্পিত আবাসনের কারণে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটছে। পাহাড়কাটা, বনাঞ্চল উজাড়, নদী-খাল ভরাট, ইসি এলাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ধ্বংস, দখল ও দূষণে ভয়ংকর পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল।

 

নানাবিধ পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে প্রকৃতি নিচ্ছে কঠোর প্রতিশোধ। বেড়েছে ঝড়ঝঞ্ঝা, বন্যা, সাইক্লোন, টর্নেডো, ভ‚মিধস, ভ‚মিকম্প। ভাঙছে উপকূল।

 

সরেজমিনে দেখা গেছে, কলাতলী হোটেল-মোটেল এলাকার পাশ দিয়ে মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে কিছুদূর এগোলে চোখে পড়বে উঁচু পাহাড়ের ঢাল। ওই পথ ধরে যতদূর এগোনো যাবে, শুধু পাহাড়ের ধ্বংসস্তপ আর হরেক রকম নির্মীয়মাণ স্থাপনা। শুধু কক্সবাজার সদর নয়, জেলার রামু, মহেশখালী থেকে শুরু করে কুতুবদিয়া বা সোনাদিয়া দ্বীপজুড়ে বনভূমি বা ম্যানগ্রোভ নিধনযজ্ঞ চলছে, যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না।

 

সরকারি সংস্থা বন বিভাগের হিসাবে কক্সবাজারের ২ লাখ ৬০ হাজার একর বনভূমির মধ্যে প্রায় ৫৬ হাজার একর বেদখল হয়ে আছে। ৭০ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও ৬৯৬ প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে সেখানকার জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ বন দখল করে আছে। প্রায় প্রতিদিন এসব বনভূমির গাছ আর পাহাড় কেটে সেখানে নিত্যনতুন স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি বনভূমি উদ্ধার নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা রয়েছে। বন বিভাগ থেকে এসব বনভূমি উদ্ধারের জন্য বারবার চিঠিও দিচ্ছে। কিন্তু বন দখলমুক্ত না হয়ে বরং আরো বেশি দখলের শিকার হচ্ছে।

 

কক্সবাজারে কারা-কীভাবে বন ধ্বংস করছে, তা নিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) যৌথভাবে একাধিক গবেষণা করেছে। তাতে দেখা গেছে, কক্সবাজার জেলায় বন ধ্বংসে এগিয়ে রয়েছে খোদ সরকারি সংস্থাগুলো। নিয়মিতভাবে নিত্যনতুন সরকারি সংস্থা সেখানকার বনভূমি ইজারা নেয়ার জন্য আবেদন করে চলেছে। অনেক সংস্থা অনুমোদন নেয়ার আগেই সেখানে স্থাপনা গড়ে তুলছে। কক্সবাজার সদর উপজেলা কমপ্লেক্সের ভেতরে পাহাড়কাটা মাটি ফেলে ভরাট করা হচ্ছে সরকারি দীঘি।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, উন্নয়ন প্রকল্প আর সরকারি সংস্থাগুলোর কার্যালয় স্থাপনের নামে কক্সবাজারকে বনভূমি শূন্য করা হচ্ছে। কীভাবে একটি দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা ধ্বংস হতে পারে, তার বড় উদাহরণ হতে পারে কক্সবাজার। অথচ সেখানকার বনভূমির উন্নয়ন এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা করাই হতে পারত উন্নয়নের মূল বিষয়।

 

বাপা, বেলা ও ইয়েসের ওই গবেষণায় দেখা গেছে, কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের জন্য যে পরিমাণে বনভূমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তার চেয়ে প্রায় আড়াই গুণ বেশি বনভ‚মি খোদ সরকারি সংস্থাগুলো বরাদ্দ নিয়েছে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার পর রান্নার জন্য জ্বালানি কাঠ সংগ্রহে একের পর এক পাহাড়ি বন উজাড় করছিল।

 

গত দুই বছর সেখানে বিকল্প হিসেবে এলপিজি গ্যাস দেয়া হচ্ছে। ফলে রোহিঙ্গা শিবিরের আশপাশের বনগুলো আবারো সবুজ হয়ে উঠছে। কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলোর নামে বরাদ্দ পাওয়া জমিগুলোর বন কেটে তৈরি করা হচ্ছে নানা অবকাঠামো।

 

গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বড় ঢল বাংলাদেশে আসার পর তাদের টেকনাফ ও উখিয়ার ৬ হাজার ১৬৪ একর বনভ‚মিতে আশ্রয়শিবির স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু রোহিঙ্গারা ধ্বংস করেছে প্রায় ১২ হাজার একর বনভূমি। বন বিভাগের কাছ থেকে ওই সংরক্ষিত বনভূমির তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। অন্যদিকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে বন্দোবস্ত দেয়া জমির পরিমাণ হচ্ছে ১৬ হাজার ৩৭২ একর। যার বড় অংশ সরকারি সংস্থা। এসব জায়গায় সরকারি সংস্থাগুলো কার্যালয়সহ নানা স্থাপনা নির্মাণ করছে।

 

এ বিষয়ে কক্সবাজারের উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন সরকার বলেন, ‘আমরা কক্সবাজারের বনের অবৈধ দখলদারদের তালিকা জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার জন্য আবেদন করেছি। আর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বন দখলকারীদের উচ্ছেদের কাজ শুরু করেছি।’

 

জানতে চাইলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. শাহীন ইমরান বলেন, সরকারি যেসব সংস্থার নামে কক্সবাজারের বনভূমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তা যথাযথ সরকারি নিয়ম মেনে করা হয়েছে। জবরদখল করা বনভূমিকে অনেকে মালিকানা দাবি করে মামলা করেছেন। তবে একদম কোনো আইনি জটিলতা নেই, কিন্তু কেউ দখল করে আছে এমন বনভূমির তালিকা বন বিভাগ থেকে দেয়া হলে অবশ্যই তা উচ্ছেদে সহযোগিতা করা হবে।

 

গবেষণায় দেখা গেছে, কক্সবাজারে এককভাবে সবচেয়ে বেশি বনভূমি বরাদ্দ নিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। সংস্থাটি সোনাদিয়া দ্বীপ ও টেকনাফের ৮ হাজার ৮৮৫ একর জমি ইজারা নিয়েছে। সেখানে তারা শিল্প ও পর্যটন অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে। এর বাইরেও মহেশখালী ও কুতুবদিয়ায় কয়েক হাজার একর বনভূমি বরাদ্দ নেয়ার জন্য আবেদন করেছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে ২০২ দশমিক ২৪ একর ও ডুলাহাজারা খ্রিষ্টান মেমোরিয়াল হসপিটালকে ১৪ দশমিক ২৪ একর বনভূমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর বাইরে সরকারের আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর নামেও বিপুল পরিমাণে বনভূমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

 


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কক্সবাজার হচ্ছে দেশের একমাত্র এলাকা, যেখানে পাহাড়ি ও সমতল ভূমি থেকে শুরু করে দ্বীপে গড়ে ওঠা ম্যানগ্রোভ বনভূমি রয়েছে। মিষ্টি পানির নদী দিয়ে শুরু হয়ে তা সমুদ্রের নোনাপানির সঙ্গে মিশেছে। সে কারণে ওই অঞ্চলকে বাংলাদেশের সবচেয়ে জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা বলা হয়।

 

প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন, বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর রাকিবুল আমীন বলেন, ঝড়-জলোচ্ছাস থেকে কক্সবাজার অঞ্চলের উপক‚লকে রক্ষায় ওই বনভ‚মি রক্ষাকবচের ভূমিকা পালন করছে। আর এশীয় বন্যহাতির অন্যতম বিচরণস্থলসহ দেশের বিলুপ্তপ্রায় অনেক বন্যপ্রাণীর আশ্রয়স্থল এই জেলার বনভূমি। ফলে এখানকার বনভূমি গুলো জরুরি ভিত্তিতে উদ্ধার করে জীববৈচিত্র্যের জন্য সংরক্ষণ করা উচিত।

 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে কক্সবাজারের প্রাণপ্রণালি, বাঁকখালী, মাতামুহুরি, নাফনদী, কোহেলিয়া ও মহেশখালী চ্যানেল নাব্য হারিয়েছে। বিশেষ করে বাঁকখালী নদীর মোহনা ভরাট করে বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে, পৌরসভার ময়লার ডিপো বানানো হয়েছে বাঁকখালী নদীকে, ভরাট করে বাঁকখালী নদীর তলদেশে নির্মাণ করা হচ্ছে শত শত স্থাপনা, ইসি এলাকায় শত শত সরকারি-বেসরকারি বহুতল ভবন, সমুদ্রসৈকতের বালি উত্তোলন করে ভরাট করা হচ্ছে নিচু এলাকা ও তিন ফসলি জমি।

 

শুধু কি তাই? কোহেলিয়া নদী ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে সড়ক। মহেশখালী চ্যনেলও নাফ নদীর কিনারা ঘেঁষে গড়ে উঠা ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করে তৈরি করা হচ্ছে হাজার হাজার একর চিংড়ি ঘের। মহেশখালী, ঘটিভাঙ্গা, বড়দিয়া, সোনাদিয়া, কালারমারছড়া, হোয়ানক, ধলঘাট মাতারবাড়ীর প্রায় ৭ হাজার একর ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ধ্বংস করেছে ভূমিদস্যুরা।

 

এমনকি মহেশখালী পাহাড়ের সাড়ে ১৮ হাজার একর সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৮০ শতাংশ বেদখল হয়ে গেছে। কক্সবাজার সদরের ঐতিহ্যবাহী পিএমখালী খালসহ জেলার ৪৬টি খাল বন্ধ করে দিয়েছে ভূমিদস্যু চক্র। রামু, কক্সবাজার শহর, সদর, চকরিয়া, পেকুয়া, উখিয়া ও টেকনাফের ১৪৯ পাহাড় কাটা হয়েছে নির্বিচারে। শুধু উখিয়াতে ৬৫টি পাহাড়। সেখানে খালের বালি ইজারা নিয়ে কাটা হচ্ছে পাহাড়। বন বিভাগ ও প্রশাসনের বাধা কোনো কাজে আসছে না।

 

কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, পাহাড়কাটাসহ পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গত এক বছরে ২৩টি মামলায় ৬৫৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। একাধিক মামলার চার্জশিটও দেয়া হয়েছে।

 

বেন-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর সহসভাপতি ড. নজরুল ইসলাম কক্সবাজারে পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকান্ড দেখে রীতিমতো হতবাক। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এভাবে পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি করে যারা ভ‚মি গ্রাস করছে, তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু। তাদের অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। কক্সবাজারের প্রাণকেন্দ্র কলাতলীতে ৫১ একর পাহাড় কেটে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উচ্চ আদালতের রায় অমান্য করে একের পর এক স্থাপনা নির্মাণ অব্যাহত রেখেছে।

 

প্রশাসন ক্যাডারদের জন্য হিমছড়ির নিকটবর্তী শুকনোছড়িতে ৭০০ একর বনভূমি বরাদ্দ নিয়ে পাহাড়কাটার পাঁয়তারা চলছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। অতিরিক্ত স্থাপনা, কেয়াবন নিধন, প্রবাল পাথর উত্তোলনে কচ্ছপ এবং লাল কাঁকড়া বিচরণক্ষেত্র নষ্ট করে সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে পড়েছে।

 

ভোরের আকাশ/নি