logo
আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ১০:৩৬
কূটনৈতিক সফলতায় আ.লীগ
নিখিল মানখিন

কূটনৈতিক সফলতায় আ.লীগ

নিখিল মানখিন: আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক কূটনৈতিক তৎপরতায় সফলতা দেখতে পাচ্ছে আওয়ামী লীগ। এমনটি মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মহল। তারা বলছেন, গত কয়েক বছরে নানা ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর বৈদেশিক চাপ বেড়ে গিয়েছিল।

 

তবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তা সামাল দিয়ে চলেছে আওয়ামী লীগ। তিক্ততা চরম পর্যায়ে যাওয়ার আগেই দলটি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছে। বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর সুনজরে পড়েছে বাংলাদেশ ও বর্তমান সরকার। বাংলাদেশে আগমন ঘটছে বিশ্বের একের পর এক প্রভাবশালী দেশের প্রতিনিধিদের।

 

২০২২ সালের শেষের দিকে এসে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে শতভাগ ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার অগ্নিপরীক্ষায় পড়ে বাংলাদেশ। কূটনৈতিক মহলের আলোচিত খবর ছিল র‌্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি, যা বিদায়ী বছরে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মাঠও উত্তপ্ত করে।

 

নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে লবিস্ট নিয়োগের কথাও বলেছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু নতুন বছরেও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়নি। তবে নতুন করে আর কোনো নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা নেই বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

 

একই কথা জানালেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। সম্প্রতি তিনি এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা দেশগুলো থেকে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা করছে না সরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের ধারাবাহিক যে অ্যাংগেজমেন্ট, মাঝে কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।

 

নিষেধাজ্ঞা, যেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি; এ কারণে হয়তো কারো আগ্রহটা বাড়তি এবং বিশেষ বাড়তি আগ্রহে পানি ঘোলা করে মাছ শিকার করার উদ্যোগ নিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত।

 

আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব প্রতিনিধি বাংলাদেশে আসবেন, তাদের সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনা হবে। তখন র‌্যাবের বিষয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়াটা পরিষ্কার হবে।

 

বৈদেশিক চাপ : ঢাকায় মায়ের ডাকের সমন্বয়কের বাসায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের যাওয়াকে কেন্দ্র করে ক‚টনৈতিক বিতর্ক গড়ায় যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার বৈরিতা পর্যন্ত। এলিট ফোর্স র‌্যাব ও এর ৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা মাথায় নিয়ে শুরু হওয়া বিদায়ী বছরে সবচেয়ে আলোচিত ছিল ঢাকা-ওয়াশিংটন টানাপোড়েন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, জাপান, জার্মানিসহ পশ্চিমা কূটনীতিকদের এ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে খোলামেলা কথা বলা ও তাদের কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলতে সরকারের বারবার তাগিদের মধ্যেও বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হয়ে ওঠে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এক অপ্রীতিকর ঘটনা।

 

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের ইস্যুতে রুশ-মার্কিন পাল্টাপাল্টি বাগবিতন্ডা ফেসবুক, টুইটার ও ঢাকা থেকে মস্কো পর্যন্ত গড়ায়। গত ২২ ডিসেম্বর রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা মস্কো থেকে বিবৃতির মাধ্যমে পিটার হাসের ঘটনার ব্যাপক সমালোচনা করেন।

 

এর মধ্যেই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কিছু জিনিসপত্র বহনকারী রাশিয়ার পতাকাবাহী কার্গো জাহাজ উরসা মেজর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে ২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি পায়নি।

 

গত ১৪ নভেম্বর ‘মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর’ অনুষ্ঠানে জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতি নাওকি বলেন, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে দেখতে চায় জাপান। তিনি আরো বলেন, গত নির্বাচনে আগের রাতেই পুলিশ ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছিল বলে আমি শুনেছি। অন্য কোনো দেশে এমন দৃষ্টান্ত নেই।

 

এবার তেমন সুযোগ থাকবে না বা এমন ঘটনা ঘটবে না বলে আশা প্রকাশ করেন জাপানি রাষ্ট্রদূত। রাষ্ট্রদূতের এমন বক্তব্যে বিব্রত পরিস্থিতিতে পড়ে আওয়ামী লীগ।

 

২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে যৌথভাবে এক বিবৃতি প্রকাশ করে ১৫টি দেশ। বিবৃতি দেয়া দেশগুলো নিজেদের বাংলাদেশের বন্ধু ও অংশীদার হিসেবে অভিহিত করেছে। তারা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও নির্বাচন বিষয়ে অঙ্গীকার রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেন। এখানেও বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয় আওয়ামী লীগের ওপর।

 

কূটনৈতিক সফলতা : বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচন, বিরোধী পক্ষের প্রতি সরকার পক্ষের আচরণ এবং মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান ‘তিক্ত সম্পর্কের’ সমাপ্তি চায় বাংলাদেশ। গত এক বছর ধরে সরকারের নানামুখী উদ্যোগের পর গত এক সপ্তাহ ধরে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকেও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমা প্রভাবশালী দেশটি বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হয় তা চায়।

 

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, গত ২/৩ বছর ধরে এসব ইস্যুতে ঢাকার ওপর ওয়াশিংটন ক্ষিপ্ত থাকলেও ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‌্যাবের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে টানাপোড়েন স্পষ্ট হয়। এ নিয়ে সরকার নানা সমালোচনার মুখে পড়ে। তবে এক বছর ধরে চেষ্টার পর গত এক সপ্তাহ ধরে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিকের দিকে যাচ্ছে।

 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারপ্রধান ও সরকারের সা¤প্রতিক কর্মকান্ড গুলো যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এর পাশাপাশি র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা, মানবাধিকার ইস্যু, বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষের প্রতি সরকারের আচরণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ কাজ করছে। এর মধ্যে গত কয়েক দিন ধরে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া প্রতিশ্রুতি আমলে নিয়েছে দেশটি। একই সঙ্গে এর পূর্ণ বাস্তবায়ন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

 

অবাধ নির্বাচন আয়োজনে বাংলাদেশ সরকার কীভাবে কাজ করছে সেটি যে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে এমনটা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস। ওয়াশিংটনে ফরেন প্রেস সেন্টারে সম্প্রতি এক বিশেষ ব্রিফিংয়ে হাজির হন তিনি। সেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া প্রতিশ্রুতি কে স্বাগত জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার করেন দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র। শুধু তাই নয়, ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের কার্যক্রমে রীতিমতো সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বাহবাও দিয়েছেন তিনি।

 

বিদেশি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নেড প্রাইস বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চান। আমরা এই চাওয়াকে স্বাগত জানাই। নির্বাচন আয়োজন করতে বাংলাদেশ সরকার কীভাবে কাজ করবে তা বুঝতে আমাদের পর্যবেক্ষণ অব্যাহত থাকবে। এ নির্বাচন হতে হবে প্রকৃত, স্বচ্ছ এবং শান্তিপূর্ণ। যদিও নির্বাচনের এখনো আরো অনেক দিন বাকি।

 

ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের দুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মঙ্গলবার বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। তারা হলেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোত্রার এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক শোল।

 

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী ভোরের আকাশকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্য ও সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে বাংলাদেশ। বিএনপিসহ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দীর্ঘ বছর ধরে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা ও অপপ্রচার চালিয়ে বিশ্ব বাসীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে আসছে। কিন্তু তাদের সে অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। অনেক আগেই কূটনৈতিক তৎপরতা জোরালো করেছে দলটি। ভুল তথ্য দিয়ে বিদেশিদের বিভ্রান্ত করার দিন শেষ হয়ে গেছে বলে জানান সুজিত রায় নন্দী।

 

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা জানান, দল গোছানোর পাশাপাশি বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনার মাত্রা বাড়িয়েছে কয়েকগুণ। নীরব কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলীয় অবস্থান এবং নির্বাচন নিয়ে সরকারের চিন্তাভাবনার বিষয়ে বার্তা দিতেই এ কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা।

 

শুধু দলীয় ব্যক্তিদের দিয়েই নয়, বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশে নিযুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালাচ্ছে হাইকমান্ড।

 

ভোরের আকাশ/নি