logo
আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ১৫:৫৭
মধ্যবিত্তের পাত থেকেও উধাও হচ্ছে ব্রয়লার মুরগি ও ডিম
শাহীন রহমান

মধ্যবিত্তের পাত থেকেও উধাও হচ্ছে ব্রয়লার মুরগি ও ডিম

শাহীন রহমান: মধ্যবিত্ত বাঙালির পাত থেকে গরু মাংস, ইলিশ মাছ উঠেছে অনেক আগেই। বাজারে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের দামও ধরাছোঁয়ার বাইরে। ঊর্ধ্বগতির এ সময়ে কিছুটা হলেও সাশ্রয়ী ছিল ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দাম। এগুলোকেই প্রাণিজ আমিষের উৎসও হিসেবে ধরা হয়। এখন এ আমিষের ওপরও কোপ পড়তে শুরু করেছে। মাছে-ভাতে বাঙালি থেকে ডাল-ভাতে নামা পাতে পুষ্টির শেষ সম্বলটুকুও উঠতে বসছে। সংশ্লিষ্টদের অভিমত, কয়েকদিন ধরে বাজারে ডিমের যে মূল্য, তা সীমিত আয়ের মানুষের কাছে ‘সাশ্রয়ী’ কোনো পণ্য নয়। বাজারের ব্যয় সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে নিম্ন, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে। জানুয়ারি মাসে যেখানে এক ডজন ডিমের দাম ছিল ১২০ টাকা বা এর আশপাশে। ফেব্রুয়ারি মাসে ডিমের দাম বেড়ে হয়েছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। প্রাণিজ আমিষের সহজলভ্য উৎস হিসেবে পরিচিত ব্রয়লার মুরগির দাম চড়তে চড়তে ২৩০ টাকা ছুঁয়েছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডিমের দাম। ঢাকার বাজারগুলোয় এক হালি ডিম কিনতে গুনতে হচ্ছে ৫০ টাকা।

 


ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ব্রয়লার মুরগির দর এতটা বাড়তে তারা দেখেননি। এক মাসের ব্যবধানে কেজিতে প্রায় ৯০ টাকা দাম বেড়েছে এ মুরগির। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২২৫ থেকে ২৩৫ টাকায়। অথচ এক মাস আগে দাম ছিল ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি। এক মাসের ব্যবধানে কেজিতে দাম বেড়েছে ৮৫ থেকে ৯৫ টাকা পর্যন্ত। সোনালির মুরগি দাম প্রতি কেজি ৩১০ থেকে ৩৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। অথচ এক মাস আগে দাম ছিল ২৭০ থেকে ২৮০ টাকার মধ্যে। দেশি মুরগির এখন সবার ভাগ্যে জুটছে না। আকাশছোঁয়া দামের কারণে অনেকর পাত থেকে দেশির মুরগির স্বাদ অনেক আগেই উঠেছে। সেইসঙ্গে উঠেছে গরুর মাংস ও ইলিশ মাছের স্বাদ। বর্তমানে গরুর মাংস প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭২০ টাকা দরে। দেশি মুরগি ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা পর্যন্ত। দামের কারণে খাসির মাংসের দিকে এখন কিউ ফিরেও তাকাতে চায় না। তারপরও বাজারে প্রতি কেজি খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকার মধ্যে। কিন্তু এ সময়ে হঠাৎ কেন ব্রয়লার মুরগির ডিমের দাম আকাশছোঁয়া। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর আগস্টেও ডিমের দাম ছিল আকাশছোঁয়া। সেই সময় ডিমের বাজারমূল্য নিয়ে সারা দেশে অনেক হইচই পড়ে যায়। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বাজার স্থিতিশীল রাখতে প্রয়োজনে বিদেশ থেকে ডিম আমদানি করার কথা বলেন তখন। এরপরই ডিমের দাম কিছুটা কম হলেও আগের দামের ফেরত আসেনি। গত কয়েক মাস ধরেই ডিমের দাম বাড়তির দিকে ছিল। গত সপ্তাহে প্রতিহালি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা করে।

 


কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে কেন এ সময়ে ডিসেম্বর দাম ও ব্রয়লার মুরগির দাম এত চড়া? কারওয়ানবাজারের মুরগি ব্যবসায়ী কামাল আহমেদ বলেন, দেশেই মুরগি নেই। এ কারণে ব্যবসায়ীরা কম দামে মুরগি কিনতে পারছে না। যে দামে কিনতে হচ্ছে, সে অনুযায়ি বিক্রি করতে হয়। এর বাইরে ব্যবসায়ীদের কিছুই করার নেই। ডিমের দামের বিষয়ে ব্যবসায়ীরা বলেন, অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে ডিমের দাম বাড়তির পথে। ক্রেতারা বলছেন, ক্রমাগত এ দাম বৃদ্ধি তাদের জীবনযাত্রার মানে প্রভাব ফেলছে। কেউ কেউ কাটছাঁট করছেন কেনাকাটায়। পাশিপাশি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পোলট্রি খাদ্যের দাম বাড়ার কারণে ডিম মুরগির দাম বেড়ে গেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে যে খাদ্য ও জ্বালানি সংকট তৈরি হয়েছে সেটার প্রভাব পড়েছে পোলট্রি খাদ্যের দামে। তারা জানা পোলট্রি খাদ্য তৈরিতে ভুট্টা, সয়ামিলসহ বিভিন্ন কাঁচামালের প্রয়োজন হয়। আর এ পোলট্রি শিল্পের প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। পোলট্রি খাদ্য, জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। সে কারণে ডিম ও মুরগির দামও বেড়েছে বলছেন ব্যবসায়ীরা। পোলট্রিশিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ^বাজারে কাঁচামালের দাম যেমন বেড়েছে, তেমনি ডলারের দামের কারণে আমদানির খরচ বেড়েছে। এছাড়া ব্যাংকগুলোয় ডলার সংকট থাকায় এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে। এ কারণে খাদ্য আমদানি বাজারে সরবরাহে ঘাটতিও তৈরি হয়েছে। ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ খাদ্যের উপাদান আমদানি হয়। সেখানে ফরেন কারেন্সির সমস্যার কারণে এ খাতে প্রভাব পড়েছে।

 

এছাড়া রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে খাদ্যের চালান আসতে সমস্যা হচ্ছে। এটাও ফ্যাক্টর বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এমএম খান। তিনি বলেন, পোলট্রি খাদ্যের চড়া দামের কারণে লোকসান দিয়ে ছোট অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে উৎপাদন এখন কম। গত এক বছরে প্রায় ৪০ শতাংশ খামার বন্ধ হয়ে গেছে। দাম এরকম বাড়তে থাকলে বাকি খামারগুলো বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, ডিমের দাম বাড়লেও খামারিরা এর কোনো সুফল পাচ্ছে না। কারণ বিভিন্ন জায়গা বিভিন্ন আড়ত ব্যবসায়ীরা ডিমের দাম নির্ধারণ করে দেয়। দেশের যে কয়টি জায়গায় দাম নির্ধারণ হয় সেটাকে কেন্দ্র করেই দেশব্যাপী ডিমের দাম ওঠানামা করে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ দাম বেঁধে দিলেও বাজারে তার প্রভাব পড়ে না, পোলট্রি খাদ্যের দাম পরিবহন খরচ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর ডিমের দাম নির্ধারণ হয়। বাজারে যে চাহিদা এর বিপরীতে কম সরবরাহ হলেও ডিমের দাম বেড়ে যায়। বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট বলছেন, উৎপাদন খরচ কমাতে না পারলে ডিমের দাম কমবে না। এদিকে শুধু ব্রয়লার ও ডিমের দাম বৃদ্ধিই নয়। দাম বেড়েছে শাকসবজিসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের। কাঁচামরিচ দাম প্রায় আকাশছোঁয়া। কিছুদিন আগেই এক কেজি কাঁচামরিচের দাম ছিল ৮০ টাকা। সেখানে দাম বেড়ে ডাবল হয়েছে। ১৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। কাঁচাবাজারের মধ্যে শীতের সবজি দাম কিছু কম। বিশেষ করে ফুলকুপি-বাঁধাকপি ৩০ টাকা পিচ বিক্রি হচ্ছে।

 


তবে শীতকালীন সবজির দাম একটু কম হলেও গরমের সবজির দাম বেশ চড়া। এক কেজি দেশি করলা বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা কেজি দরে। শীতের সবজি শিমের দাম বেশ চড়া। এক কেজি শিম বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। লাউ প্রতি পিস ৭০ টাকার নিচে পাওয়া দুষ্কর। তবে বরাবরে মতো আলুর দাম বেশ সস্তা। নতুন আলুও কেজিতে ২৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে পাল্লা ধরে নিলে আরো কিছু কম পড়ে। নতুন পেঁয়াজ তিন কেজি ১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে বাজারে আগাগোড়াই মাছের দাম চড়া। বড় সাইজের রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকার ওপরে। তবে ছোট সাইজের রুই ২৯০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। তবে মাছের মধ্যে পাঙ্গাস, তেলাপিয়া ও চাষের কই দাম কিছুটা হলে কম। ২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। দেশি মাছের মধ্যে বড় শোল মাছ ১ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

 

এছাড়া বিভিন্ন ধরনের নদীর মাছের দাম বেশ চড়া। সাধারণ মানুষের নাগালে বাইরে। বাজারে এখন চিনি মেলাই যেন ভার। বিক্রেতারা বলছেন, চাহিদা অনুযায়ী বাজারে চিনি ছাড়ছে না কোম্পানিগুলো। খোলা চিনি পাইকারিতে কিনতে হচ্ছে ১১২ টাকায়, আর খুচরা বিক্রি হচ্ছে ১১৫ টাকায়। যদিও খোলা চিনি সরকার নির্ধারিত দাম অনুযায়ী কেজি প্রতি ১০৭ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। সরকার নির্ধারিত দামে প্যাকেটের চিনির দাম হওয়ার কথা ১১২ টাকা কেজি। কিন্তু বাজারে প্যাকেটের চিনি উধাও। যদি কোথাও পাওয়া যায়, সেটা ১৩০ টাকার কমে মিলছে না। কিছু দোকানে দেশি লাল চিনির প্যাকেট মিললেও তা বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ টাকা কেজি দরে।

 

ভোরের/মি