রাশেদ রাব্বি: গ্রামের নাম মূখী। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার অন্তর্গত এই গ্রাম। এখানকার সব মানুষের জীবিকার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে ‘হাতপাখা’। গ্রামের প্রতিটি ঘরেই তৈরি হয় বাঁশ ও কাপড়ের পাখা। সুই-সুতোয় গাঁথা নকশি পাখা, স্কিন প্রিন্টে ছাপানো রঙিন কাপড়ের পাখা। এই পাখার শীতল বাতাসে যেমন অনেকে প্রাণ জুড়ান, তেমনি ফিরেছে মূখী গ্রামের মানুষের ভাগ্য।
এ বিষয়ে কথা হয় বিলকিস বেগমের সঙ্গে। একসময় ভাগ্য বিড়ম্বিত জীবন-যাপন করলেও পাখা তৈরি করে ফিরেছে তার ভাগ্য। এখন তিনি স্বাবলম্বী, জীবন-যাপনে সচ্ছলতার ছাপ।
বিলকিস জানান, বছর কয়েক আগেও তার অর্থিক অবস্থা এমন ছিল না। বেঁচে থাকার জন্য স্বামী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় কাজ করেছেন। কিন্তু দুজনে মিলে আয় করেও চলতে পারতেন না। তবে হাতপাখা বানানোর কাজ শিখেছিলেন শৈশবে। শেষ পর্যন্ত সেই পাখাতে ভর করেছে জীবনের চাকা। এক বছরে প্রায় তিন লাখ পাখা উৎপাদন ও বিক্রি করেন তিনি। এ কাজে তাকে সহায়তা করছে আরো দশ জন নারী। যারা প্রতিদিন গড়ে এক হাজার পাখা তৈরি করেন। এতে করে মাসে প্রায় ত্রিশ হাজার পাখা তৈরি হয় তার উঠানে। সিলেট, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুর, বরিশালের ব্যবসায়ীরা তার বাড়ি থেকে পিকআপ ভর্তি করে নিয়ে যান পাখা।
বিলকিস জানান, হাতল ছাড়া একটি পাখা তিনি বিক্রি করেন ২৫ থেকে ৫০ টাকায়। পাখার হাতলগুলো আলাদা বিক্রি হয় শ’ হিসেবে। রং-বেরংয়ে কাপড়ের ওপর নানা বর্ণের সুতোয় নকশা করা পাখাগুলো বিক্রি হয় গড়ে ৫০ টাকায়। বিশেষ নকশার পাখা হলে সেগুলোর দাম পড়ে ৬০ টাকা। অন্যদিকে কাপড়ের ওপর স্ক্রিন প্রিন্টের ডিজাইনের পাখাগুলো বিক্রি হয় ২০ থেকে ২৫ টাকায়। একশ পাখা তৈরির মজুরি হিসেবে একজন কর্মী পান ৮০০ টাকা। তার দশজন কর্মী এভাবে পাখা তৈরি করে মাসে আয় করেন ২০ থেকে ২৪ হাজার টাকা। যেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে একজন গার্মেন্ট কর্মী বেতন পান মাত্র ৮ থেকে ১২ হাজার টাকা।
বিলকিস জানান, মাত্র দু’বছর আগেও তিনি একাই পাখা তৈরি করতেন। টাকার অভাবে ব্যবসায়ীদের অর্ডার নিতে পারতেন না। এমন সময় তার পাশে দাঁড়ায় ড্যাম ফাউন্ডেশন। ২০২১ সালের মার্চে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সদস্য হন। পরে এখান থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করে পাখার ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। এতেই ঘুরতে শুরু করে তার ভাগ্যের চাকা। এ টাকা পরিশোধ করে তিনি ড্যাম ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকা ঋণ সুবিধা পান। তারপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সেই টাকা দিয়ে স্কিন প্রিন্টের একটি সেট কিনেছেন। নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীর কাপড়ের বাজার থেকে স্বল্প দামে কিনে এনেছেন এক বছরের পাখা তৈরির কাপড়। আগে পাখার কাঠামোর তৈরির বাঁশ কিনতেন একটি-দুটি করে। কিন্তু এবার তিনি পুরো একটি বাঁশবাগান কিনে রেখেছেন। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহেও তিনি প্রায় পাঁচ হাজার পাখা বিক্রি করেছেন। এখনো চলছে অর্ডারের কাজ। চরমোনাই পীরের স্লোগান সংবলিত ১০ হাজার পাখা তৈরির কাজ চলছে। বিলকিসের বাড়িতে পাখা তৈরি যেন একটি উৎসব। তার দশ বছরের প্রতিবন্ধী মেয়েও প্রতিদিন সবার সঙ্গে বসে পাখা বানায়। ছেলেকে ভর্তি করিয়েছেন স্কুলে।
বিলকিস বলেন, আগে তার স্বামী দিনমজুরের কাজ করতেন। এখন পাখা তৈরিতে সাহায্য করেন। পাখা বিক্রির টাকা দিয়ে গরু কিনেছেন। টিনের ঘর তুলেছেন তিনটি। একটিতে নিজেরা থাকেন; একটিতে পাখার সরঞ্জাম রাখা হয়, অরেকটি গরু রাখার জন্য। বিনোদনের জন্য কিনেছেন ৫০ ইঞ্চি স্মার্ট টিভি। খাবার সংরক্ষণের জন্য আছে ফ্রিজার। এখন তার স্বপ্ন বাড়িটি পাকা করবেন, বাড়াবেন ধানি জমির পরিমাণও, পাখার কাঁচামাল আনা-নেয়া করতে কিনবেন একটি পিকআপ।
কথা হয় বিলকিসের পাখা কর্মী রিমা, পাপিয়া, লাভলী, হাসি ও লাকির সঙ্গে। তারা জানান, পাখার কাজ করে তারাও স্বাবলম্বী। একসময় গার্মেন্টে সকাল-সন্ধ্যা কাজ করতেন সাত থেকে আট হাজার টাকার জন্য। এখন সকালে নাস্তা করে পাখা তৈরি শুরু করেন, দুপুরে বাড়িতে গিয়ে রান্নাবান্না করেন, সন্তানের দেখভাল করে আবার বিকেলে এসে পাখা বানান। এতেই তারা মাসে ২০ হাজার টাকার বেশি রোজগার করেন। তারা ভালো আছেন।
ময়মনসিংহের ভালুকা বাসস্ট্যান্ড থেকে পূর্ব-পশ্চিমে যে সড়কটি চলে গেছে, সেটি ধরে কিছুটা এগোলেই মূখী গ্রাম। গ্রামের শান্ত-সুনিবিড় ছায়া-শীতল পথ ধরে চলতেই দেখা হয় মোরশেদ আলীর সঙ্গে। তিনিও এ গ্রামের বাসিন্দা।
মোরশেদ জানান, এ গ্রামের প্রায় চল্লিশটি ঘরে পাখা তৈরি হয়। এই গ্রামেই বছরে তৈরি হয় ১০ থেকে ১২ লাখ পাখা। যেগুলো পৌঁছে যায় ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশালের গ্রামগঞ্জে, মানুষের হাতে হাতে।
গ্রামবাসী জানান, গ্রীষ্মকাল ছাড়াও আশ্বিন, কার্তিক, চৈত্রসহ কয়েক মাসে প্রচণ্ড দাবদাহ এবং ভ্যাপসা গরম পড়ে। গরমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কর্মচাঞ্চল্যও বাড়ে ‘মূখী গ্রাম’-এর মানুষদের। এ সময় বাঁশের ফ্রেমের ওপর নকশি কাপড় দিয়ে তৈরি পাখার চাহিদা বেড়ে যায় বহুগুণ। পাখা বানিয়ে অনেকের সংসারে ফিরেছে সচ্ছলতা। এ কাজে গ্রামের নারীরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন।
প্রসঙ্গত, ড্যাম ফাউন্ডেশন ফর ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট (ডিএফইডি) ঢাকা আহছানিয়া মিশন (ডিএএম)-এর একটি বিশেষ অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান। ২০১৪ সালের জুন মাসে প্রতিষ্ঠিত এই ফাউন্ডেশন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছে।
ভোরের আকাশ/আসা