logo
আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ১০:৩৫
লক্ষীপুরে ইটভাটা
নদীভাঙন-জোয়ারে বিধ্বস্ত উপকূল
রিয়াজ মাহমুদ বিনু, লক্ষীপুর

নদীভাঙন-জোয়ারে বিধ্বস্ত উপকূল

রিয়াজ মাহমুদ বিনু, লক্ষীপুর: অসময়ে মেঘনায় অস্বাভাবিক জোয়ায়ের হানা আর অপরিকল্পিত ইটভাটা ও নদীভাঙনের প্রভাবে প্রতিনিয়তই বিপন্ন হচ্ছে লক্ষীপুরের উপক‚লীয় এলাকার পরিবেশ। সময়ে-অসময়ে জোয়ার হানা দেয়ায় জমির উপরিভাগে নোনা জমে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে চাষাবাদ।

 

অপরিকল্পিতভাবে ইটভাটা স্থাপনে ধ্বংস হচ্ছে বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল ও কৃষিজমি। ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করায় সরকারি- বেসরকারি বন উজাড় হচ্ছে। অন্যদিকে নদীভাঙনের শিকার হওয়া মানুষের কৃষি জমিতে অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ করায় হারিয়ে যাচ্ছে কৃষিজ জমি।

ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ার প্রভাবে বিপন্ন বিস্তীর্ণ জনপদের মানুষজন। বিষিয়ে উঠছে তাদের জীবনযাত্রা ও স্বাভাবিক বসবাস। নানা জটিল রোগে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে এলাকার শিশুসহ নানা বয়সি লোকজন। দেদার এসব ইটভাটায় প্রকাশ্য কাঠ পোড়ানো হলেও কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় একদিকে এলাকার বনজসম্পদ কমে আসছে, অন্যদিকে পরিবেশদূষণ হচ্ছে মারাত্মকভাবে। ইটভাটার দূষিত কালো ধোঁয়ায় আশপাশের বিভিন্ন গাছপালা, বাড়িঘর মারাত্মকভাবে ক্ষতির কবলে পড়ছে।

 

সরেজমিনে দেখা গেছে, এসব এলাকার গাছের পাতায় জট ধরেছে, পানি ছাড়া অপরিপক্ব নারিকেল ধরছে। অকালে মরে যাচ্ছে ছোট-বড় গাছ। নলকূপে পাওয়া যাচ্ছে না পানি।

 

চিকিৎসা বিজ্ঞানের তথ্যমতে, ইটভাটা থেকে নির্গত নানান দূষিত উপাদান মানবদেহে শ্বাস- প্রশ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করলে রেসপিরেটরি সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ফলে ইটভাটার আশপাশে বসবাসরত মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বেশি দেখা যায়। মোটা দাগে বলা যেতে পারে, বায়ুতে দূষিত উপস্থিতিতে ফুসফুসে ক্যান্সার, হার্টঅ্যাটাক ও অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাবে মৃত্যুর হার বেড়ে যাচ্ছে।

 

লক্ষীপুরের পাঁচটি উপজেলার সবগুলোতেই অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে রামগতি উপজেলায় বত্রিশটি, কমলনগর উপজেলায় বাইশটি ইটভাটা রয়েছে। ইটভাটা স্থাপনে খাল, নদী-নালা ইত্যাদি দখল করে রাস্তাঘাট কিংবা বাঁধ নির্মাণ করায় বিঘ্নিত হচ্ছে পানির স্বাভাবিক গতিপথ। এর ফলে জলাবদ্ধতায় ভুগছে লোকালয় ও ফসলি জমি।

 

কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ভর্তুকির সরকারি সুবিধা নিয়ে কেনা অসংখ্য অবৈধ ট্রাক্টর-ট্রলি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো জেলায়। এর ফলে গ্রামীণ জনপদে সামাজিক অবকাঠামো ভেঙে সৃষ্টি করেছে নানা বিপর্যয়। ক্ষত-বিক্ষত করছে গ্রামীণ কাঁচা, পাকা ও আধাপাকা সড়ক। অন্যদিকে নির্বিচারে কাঠ পোড়ানোয় ধ্বংস হচ্ছে দেশি-বিদেশি নানা প্রজাতির গাছগাছালি।

 

ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি ‘টপসয়েল’ বিক্রিতে হ্রাস পাচ্ছে জমির উর্বরা শক্তি। ইটভাটা তৈরিতে একদিকে যেমন কৃষিজমি ধ্বংস করা হচ্ছে, অন্যদিকে দখল করা হচ্ছে সরকারি খাল, নদী ও খাস জমি। এসব ভাটায় যানবাহন যাতায়াতে তৈরি করা হচ্ছে অবৈধ সড়ক। ভাটার মালিকানায় জনপ্রতিনিধিরা যুক্ত থাকায় খাল-নদী দখল করে দেয়া হচ্ছে রাস্তা তৈরির প্রকল্প।

 

বিগত তিন দশক ধরে প্রমত্তা মেঘনার ভাঙনে বিপর্যস্ত এ উপক‚লীয় জেলা। রামগতি বয়ারচর থেকে সদর উপজেলার মজুচৌধুরীরহাট পর্যন্ত প্রায় সত্তর কিলোমিটার এলাকার বিস্তীর্ণ জনপদ ভাঙনের শিকার হচ্ছে। বেড়িবাঁধ না থাকায় মারাত্মক হুমকির মধ্যে রয়েছেন রামগতি, কমলনগর, লক্ষীপুর সদর এবং রায়পুর উপজেলার উপকূলীয় জনসাধারণ।

 

ইতোমধ্যে রামগতি-কমলনগর এলাকার বত্রিশ কিলোমিটার মেঘনা তীর সংরক্ষণ বাঁধের জন্য গত বছর ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকার প্রকল্প গৃহীত হলেও কাজ দৃশ্যমান হয়নি। তীর সংরক্ষণ বাঁধ না থাকায় মেঘনায় হচ্ছে তীব্র ভাঙন। এর ফলে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে বিসণ জনপদ ও সরকারি-বেসরকারি বনভূমি। গত এক দশক ধরে বিলীন হয়েছে রামগতি উপজেলার বয়ারচরের হাজার হাজার একরের সরকারি ঝাউবাগান।

 

লক্ষীপুর জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. হারুন অর রশিদ পাঠানের কাছে এ ব্যাপারে জানার জন্য একাধিকবার মুঠোফোন নম্বর ০১৭১২২০৬২৫৯-তে কল দেয়া হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. আনোয়ার হোসাইন আকন্দ বলেন, ইতোমধ্যে অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। নদীতীর সংরক্ষণ বাঁধের কাজ কিছু কিছু এলাকায় শুরু হয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/নি