logo
আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ১৫:৪৮
ধূলা-দূষণে পরিবেশ বিপর্যয়: হুমকির মুখে জনস্বাস্থ্য
সুশীল সরকার রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি

ধূলা-দূষণে পরিবেশ বিপর্যয়: হুমকির মুখে জনস্বাস্থ্য

দাউদপুরের দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ নষ্ট করে গড়ে তোলা হয়েছে ইটখোলা

সুশীল সরকার রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি: সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলায় ছিল ভরপুর। সবজির ভান্ডার বলা হতো দাউদপুর ইউনিয়নকে। এখনো এখানে সবজি ফলে। ফলে ফলমূল। সবুজে মোড়ানো ছিল গোটা ইউনিয়ন। কতিপয় হতকুচ্ছিত দানবের লোভের শিকার এখানকার ৬০ হাজার মানুষ। মাত্র ৬৪ জন স্বার্থবাদী মানুষের কারণে দাউদপুরের মানুষের জীবন দূর্বিষহ হয়ে উঠেছে।

 

ইটভাটার ধূলা আর দূষণে পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে। হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে রাস্তাঘাট। কালেভদ্রে প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান পরিচালনা করলেও আবার চলে ইটখোলা। গত প্রায় দুই যুগ ধরে এসব ইটভাটার কারণে দাউদপুরের পরিবেশ বিপর্যয় হয়ে আসলেও রক্ষা করায় এগিয়ে আসেনি কেউ।

 

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ইউনিয়নের যেদিকে চোখ যায় শুধুই ইটের ভাটা। এ যেন ইটভাটার ঘরবসতি। ফসলি জমি, নদের তীরে সারি সারি ইটভাটা। নুরুন্নেসা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, দেবই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাজীরবাগ মাদ্রাসা, খাস কামালকাঠি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ইটভাটা। বাড়িঘর ঘেঁষেও রয়েছে ইটভাটা।

 

দাউদপুরের অধিকাংশ মানুষই কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। ইটভাটার কারণে এ এলাকার কৃষি আজ বিপর্যয়ের মুখে। ইটভাটার বিষাক্ত ধোয়া আর ধূলাবালিতে দাউদপুর ইউনিয়নের কৃষি ও পরিবেশ বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে। ইটখোলার মাটি বহনকারী ইছারমাথা (ট্রাক্টর) চলাচলের কারণে এ এলাকার রাস্তাগুলো ভেঙে-চুরে একাকার হয়ে গেছে। বাসযোগ্যহীন হয়ে পড়েছে দাউদপুর।

 

উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা কৃষি অফিস, পরিসংখ্যান অফিস, পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, এ ইউনিয়নের আয়তন ২৭.৫ বর্গকিলোমিটার। দাউদপুর ইউনিয়নে ১১২০ হেক্টর আবাদি জমি রয়েছে। আর জনসংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। শীতলক্ষ্যা নদের তীর ঘেঁষে সারি সারিভাবে গড়ে উঠেছে ইটের ভাটা। সরকারি অনুমোদন ছাড়াই এসব ইটভাটা গড়ে উঠেছে। উপজেলা প্রশাসনের তালিকায় দাউদপুর ইউনিয়নে রয়েছে ৪০টি ইটভাটা।

 

আর তালিকার বাইরে রয়েছে আরো ২৪টি। এসবের মধ্যে ৪টির বৈধতা রয়েছে। পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে প্রশাসনের নাকের ডগায় একের পর এক ইটখোলা গড়ে উঠলেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন, থানা পুলিশ, পরিবেশ অধিদপ্তর, মস্তানদের ম্যানেজ করেই অবৈধ ইটভাটা চালিয়ে যাচ্ছে। নামমাত্র ইউনিয়ন পরিষদের ট্রেডলাইসেন্স নিয়ে ইটখোলাগুলো চলছে।

 

দাউদপুরের খৈশাইর এলাকার কৃষক ফকির আলী বলেন, ইটখোলার কারণে আমাগো ক্ষেত-খামারো আগের মতন ফলন অয় না। গাছে ফল আহে না। আগে নারিকেল গাছে ডাবের কাদি ঝুইলা থাকত। অহন ডাবগুলান ছিট পইড়া যায়গা। খাস কামালকাঠি এলাকার শিক্ষক রতন বসাক বলেন, একসময় দাউদপুরে বইত নির্মল বাতাস। চারদিক ছিল সবুজের সমারোহ।

 

এখন যেদিকে চাইবেন ইটভাটা আর ইটভাটা। ধোয়া আর ধোলায় একাকার। অভিযান চলে আবার শুরু হয়। পুটিনা এলাকার মাহমুদুল ইসলাম বলেন, সবুজ দাউদপুর শেষ করে দিল ইটভাটা। ২০ বছর আগে এ এলাকায় বিভিন্ন প্রজাতির ফলমূল হতো। এখন দেখাই মেলে না। ইটভাটা বন্ধ না হলে এলাকার চরম ক্ষতি হয়ে যাবে।

 

একই এলাকার গৃহবধূ আয়েশা খানম বলেন, ইটভাটার ধূলা আর ধোঁয়ার কারণে ছেলেমেয়েরা শ্বাসকষ্ট সহ নানা রোগে ভোগে। এভাবে চললে দাউদপুরে বাস করা অসম্ভব হয়ে উঠবে।

 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দাউদপুরের দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ নষ্ট করে গড়ে তোলা হয়েছে ইটখোলা। যেখান থেকে ইউনিয়নের শুরু সেখান থেকে ইটভাটারও শুরু। আবার যেখানে ইউনিয়নের শেষ সেখানে ইটভাটাও শেষ। লোকালয় ও নদী থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে ইটখোলা করার নিয়ম থাকলেও কেউ তা মানছে না। কৃষিজমিতে ইটখোলা তৈরির আইনগত নিষেধ থাকলেও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই দাউদপুরে ইটখোলা গড়ে উঠেছে।

 

সরেজমিনে আরো দেখা গেছে, এসব ইটখোলার সামনে কাঠ আর টায়ারের স্তুপ। এগুলো পোড়ানোর নিয়ম না থাকলেও এ এলাকার ইটখোলাগুলো তা মানছে না। বিষাক্ত টায়ার পোড়ানোর কারণে এলাকার বাতাসও দূষিত হয়ে পড়েছে। ফলে মানুষ শ্বাসকষ্ট, চর্ম, হাঁপানিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

 

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত বছর দাউদপুরের দুয়ারা এলাকার মেসার্স মইন-অধরা ব্রিকসকে ২ লাখ, দুয়ারা পুটিনা এলাকায় হেলাল ব্রিকসকে ১ লাখ, দাউদপুর এলাকায় মেসার্স সালাম ব্রিকস-২কে ২ লাখ টাকা, মেসার্স সততা ব্রিকসকে ৫ লাখ, মেসার্স আরকেএম ব্রিকসকে ২ লাখ ও মেসার্স থ্রিএ ব্রিকসকে ৩ লাখসহ মোট ৬টি ইটভাটা থেকে সর্বমোট ১৫ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের সদর দপ্তরের এনফোর্সমেন্ট শাখার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কাজী তামজীদ আহমেদের নেতৃত্বে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়।

 

চলতি বছরের নভেম্বর মাসে ৩টি ইটভাটায় জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনা করা হয়। পরে ৩ ইটভাটার মালিককে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। গত ৪ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর এবং ১২ থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত চলা ৬ দিনের অভিযানে লক্ষ্যা শিমুলিয়া, বেলদী ও খৈসাইর এলাকায় প্রায় ৩০টি ইটভাটার অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

 

দুয়ারা এলাকার হেলালউদ্দিন ইটভাটার মালিক হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ইটভাটার কারণে এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণ মানুষ কাজ করে খাচ্ছে। আমরাতো ক্ষতি করছি না। ইটভাটার মালিক মজিবুর রহমান বলেন, এটা তো অন্যায় কিছু নয়। আমাদের কারণে অনেক মানুষ খেয়েদেয়ে বেঁচে আছে। তা ছাড়া আমরা সবার সাথে কথা বলেই ইটভাটা চালাচ্ছি।

 

রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আইভী ফেরদৌস বলেন, বায়ুদূষণের ফলে জনস্বাস্থ্যের ওপর তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। লোকজন শ্বাসতন্ত্র, ফুসফুস রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। দূষিত বায়ুর কারণে হৃদযন্ত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতিরিক্ত দূষিত বায়ু সেবনে গর্ভবতী নারী ও শিশু স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে, বায়ু দূষণের কারণে জন্মের আগেও শিশু মারা যেতে পারে। শিশুরাই বায়ুদূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

 

রূপগঞ্জ থানার ওসি এএফএম সায়েদ বলেন, থানা পুলিশ বরাবরই প্রশাসনকে সহযোগিতা করে আসছে। প্রশাসন অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করলে পুলিশ প্রস্তুত রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর বেশ কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করেছে।

 

সামনে আবারো অভিযান চালাবে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফয়সাল হক বলেন, ইটভাটার কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে এটা সত্য। এক মাস আগে ইটভাটার মালিকদের নিয়ে বৈঠক করেছি। বলে দেয়া হয়েছে যাদের লাইসেন্স আছে কেবল তারাই ইটভাটা চালাতে পারবে। এর কয়েকদিন পরই প্রশাসনের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়েছে। এ সময় কয়েকটি ইটভাটাকে প্রায় ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।

 

ভোরের আকাশ/নি