ইমরান আলী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ফিরে: অস্ত্র কারবারিদের নগদ টাকার লোভে পড়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সীমান্ত উপজেলা শিবগঞ্জের শত শত পরিবার। পরিবারগুলো এখন প্রায় পথে বসার পথে। এ সংখ্যা আরো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সীমান্ত লাগোয়া এলাকায় একশ্রেণির কারবারি সীমান্তের ওপার থেকে নানা কৌশলে অবৈধ অস্ত্র দেশে আনছে।
আর এই অস্ত্রের ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিতে ব্যবহার করা হচ্ছে দিনমজুর, কৃষক, অটোচালক থেকে শুরু করে একেবারে নিম্ন শ্রেণির মানুষ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে দীর্ঘদিন থেকে এ কৌশল তারা ব্যবহার করছে। আর এই ফাঁদে পড়ে অস্ত্রসহ ধরা পড়ার পর বছরের বছর কারাগারে থেকে পরিবারগুলো নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে গেছে।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, একশ্রেণির কারবারি অস্ত্রের ব্যবসা করলেও তারা ধরা পড়ছে না। ধরা পড়ছে যারা, তারা বাহক। এর বাহক হিসেবে বেশির ভাগই নি¤œ শ্রেণির মানুষ ব্যবহৃত হচ্ছে। অস্ত্রের বাহকের পাশাপাশি কারবারিদের গ্রেপ্তারের দাবি তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৭ সালের ১৩ নভেম্বর ৬টি বিদেশি পিস্তল, ম্যাগজিন ও গুলিসহ একটি বড় চালান নিয়ে বিজিবির হাতে আটক হন শিবগঞ্জের নামোচকপাড়া গ্রামের ষাটোর্ধ্ব মজনু মিয়া। একসময় সহজ-সরল ও সাজানো-গোছানো সংসার ছিল মজনু মিয়ার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে বাহক হিসেবে তাকেই টার্গেট করে অস্ত্র কারবারি সিন্ডিকেট।
লোভে পড়ে রাজিও হয় মজনু মিয়া। অস্ত্র বাসায় রাখার পরপরই বিজিবির গোয়েন্দাজালে পড়ে যায় মজনু। মজনু গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘদিন জেলে থাকার পর জামিনে বের হয়। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হওয়ায় জামিন বাতিল হয়ে কারাগারে রয়েছে।
তার বাসায় গেলে কথা হয় মজনু মিয়ার স্ত্রী বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি কিছুই জানতাম না। রাতে বিজিবির একটি দল এসে বাড়ি তল্লাশি শুরু করে। একটি বস্তার মধ্যে রাখা অস্ত্র দেখিয়ে আমার স্বামীকে নিয়ে চলে যায়। ওই সময় আমি অনেক কান্নাকাটি করি। কিন্তু তারা কোনো কথাই শোনেনি। কে বা কারা বা তার স্বামী এগুলো রেখেছে কিনা সে বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
তিনি বলেন, কৃষিক্ষেত করেই তাদের সংসার চলত। কোনো অভাবই ছিল না। স্বামীর মামলা চালাতে গিয়ে একেবারে অসহায় হয়ে গেছেন। বর্তমানে জামাই ও স্বামীর ভাইদের ওপর ভরসা করেই চলতে হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অস্ত্রের যারা ব্যবসা করে তারা লোক বেছে বেছে সর্বনাশ করে চলেছে।
২০২১ সালের ২৪ এপ্রিল র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন একই উপজেলার দাইপুকুরিয়া ইউনিয়নের লস্করপুর গ্রামের অটোচালক ডালিম। ডালিমেরও সংসার চলত অটো চালিয়ে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তিনি ভালোই চলছিলেন। হঠাৎই সিন্ডিকেটের টার্গেটে পড়ে অস্ত্র বহনে রাজি হন। রোজার মধ্যে সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হয়ে অস্ত্র নিয়ে বাসায় আসার পথে র্যাবের জালে ধরা পড়েন। দীর্ঘ ১৯ মাস কারাভোগের পর উচ্চ আদালতের আদেশে বর্তমানে তিনি জামিনে রয়েছেন।
তার বাড়িতে গেলে দেখা যায়, তিনি মামলার হাজিরা দিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে গেছেন। কথা হয় তার স্ত্রীর সঙ্গে। তার স্ত্রী মমতাজ বেগম বলেন, আমি কিছুই জানতাম না। ইফতারির পর বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। এরপর রাতে কয়েকবার মোবাইলে ফোন দিলে বন্ধ পাই। পরে ভোররাতে থানা থেকে পুলিশ ফোন দিয়ে অস্ত্র নিয়ে আটকের কথা জানায়।
তিনি বলেন, আমি কোনোদিনই ভাবিনি আমার স্বামী অস্ত্র নিয়ে ধরা পড়বে। আর অস্ত্র কেনার টাকাই বা কই পাবে। আমাদের অটো চালিয়ে সংসার চলে। আমরা কীভাবে কি করব।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেউ তাকে এগুলো দিয়েছে। তবে কারা দিয়েছে সে ব্যপারে আমারে কোনো কিছু জানায়নি। কারবারিদের টার্গেট থেকে বাদ পড়েনি হাসধরা গ্রামের ছোট টং চা দোকানদার মোক্তার আলীও। তাকে দিয়েও অস্ত্র পাচারের চেষ্টা করে সিন্ডিকেট। কিন্তু চাঁপাইনবাবগঞ্জ পার হতে পারেনি মোক্তার। ধরা পড়ে যায় র্যাবের হাতে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির এমন কান্ডে দুমড়েমুচড়ে যায় তার সংসার।
সন্তান নিয়ে স্ত্রীও চলে যান বাপের বাড়ি। আড়াই বছর কারাভোগের পর বড় বোনদের সহায়তায় উচ্চ আদালতের আদেশে জামিন পান মোক্তার। জামিনের পর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় থাকেন মোক্তার। রাজমিস্ত্রির কাজে সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করেন। তার বাড়িতে গিয়ে কথা হয় বড় বোন এরিনার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার ভাইয়ের এমন কান্ডে আমরা খুবই হতাশ। সে কেন অস্ত্রের সঙ্গে জড়াবে।
তিনি দাবি করে বলেন, কেউ তাকে ফাঁদে ফেলেছে। তাছাড়া তার একাজে জড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। তার হাতে টাকা না থাকলে সে কীভাবে জড়াবে। তিনি বলেন, এখন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় থেকে রাজমিস্ত্রির কাজ করে।
যে সীমান্ত দিয়ে আসছে অস্ত্র : স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে ও অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শিবগঞ্জ উপজেলার সীমান্ত এলাকার অন্তত ১০টি স্থান দিয়ে আসছে অস্ত্র। এগুলো তেলকুপি, সোনামসজিদ, কিরনগঞ্জ, জমিনপুর, চড়ালডাঙ্গা, ফুটানিবাজার, বর্জাটেক, বাখর আলী, চরবাকডাঙ্গা এবং সুন্দরপুর।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সীমান্ত এলাকা পার হয়ে সীমান্তের এপারের কোনো নির্দিষ্ট স্থানে রাখা হয় অস্ত্র। এরপর তা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেয়া হয়। আর এ পৌঁছে দেয়ার কাজ করে দিনমজুর, কৃষক, অটোচালক বা নিম্ন শ্রেণির লোকজন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে দীর্ঘদিন এ কৌশল ব্যবহার করে আসছে অস্ত্র কারবারি এ সিন্ডিকেট।
এরই মধ্যে অনেকে ধরা পড়েছেন। অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির কারণে অনেকেই আটক হচ্ছেন। আর আটক হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে দরিদ্র ওই ব্যক্তি দরিদ্র থেকে আরো দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। মামলা চালাতে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে পরিবারগুলো। চাঁপাইনবাগঞ্জ জেলায় এ লোভে পড়ে শত শত পরিবার এখন পথে বসে গেছে।
স্থানীয়রা বলেন, একটি অস্ত্র ৩০/৪০ হাজার টাকায় ওপার থেকে এনে দেশের অভ্যন্তরে ১ থেকে দেড় লাখ টাকায় বিক্রি হয়। এক্ষেত্রে তারা বাহককে ঢাকায় নির্দিষ্ট জায়গামতো পৌঁছে দিতে পারলে ৩০ হাজার টাকা দেয়। আর রাজশাহী পর্যন্ত পৌঁছে দিলে পায় ১০ হাজার টাকা। নগদ টাকার এ লোভে পড়েই সর্বস্ব হারাচ্ছে এরা। অস্ত্রের বাহক নিয়ে কথা হয় শাহবাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলমগীর রেজার সঙ্গে।
তিনি বলেন, সীমান্তঘেঁষা বাসকরা শতকরা ৮০ শতাংশ মানুষই দিনমজুর। নানা কাজ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে। নগদ টাকার লোভে তারা সহজেই পড়ে যায়। আর যারা অস্ত্রের ব্যবসা করে, তারাই এদের টার্গেটের শিকার হয়। এ কারণেই এসব ঘটনা ঘটছে।
তিনি বলেন, বাহক গ্রেপ্তারের পাশাপাশি যদি গডফাদাররা গ্রেপ্তার হতো তাহলে এটি ছড়াত না। কিন্তু গডফাদাররা বরাবর ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। এসব গডফাদারকে আইনের আওতায় আনা গেলে একদিকে অবৈধ অস্ত্র দেশে প্রবেশের প্রাবণতা কমত, পাশাপাশি নিরীহ এসব লোককে তাদের শিকারে পরিণত হতে হতো না।
রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি আব্দুল বাতেন বলেন, চোরাকারবারিরা তাদের পণ্য পাচারে নানা কৌশল ব্যবহার করে। আমরা তৎপর বলেই এটি হাতবদলের আগেই গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হচ্ছি। তিনি বলেন, আমরা গডফাদারদেরও আইনের আওতায় আনতে চাই। এ লক্ষ্যে কাজ করছি।
ভোরের আকাশ/নি