logo
আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ১২:১৩
ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ সিলেট
৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ধ্বসে পড়বে ৮০% ভবন
খালেদ আহমদ, সিলেট

৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ধ্বসে পড়বে ৮০% ভবন

খালেদ আহমদ, সিলেট: দেশের উত্তরে টেকটোনিক প্লেটের তিব্বত সাব-প্লেট, ইন্ডিয়ান প্লেট এবং দক্ষিণে বার্মা সাব-প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ইন্ডিয়ান প্লেট পূর্ব দিকে বার্মা পে¬টের নীচে তলিয়ে যাচ্ছে আর বার্মা প্লেটে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে সেখানে যে পরিমাণ শক্তি জমা হচ্ছে, তাতে ৮ মাত্রার অধিক ভূমিকম্প হতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেটকে ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ হিসেবে বিবেচিত করে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চল ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে।

 

গত দুই বছরে সিলেটে অন্তত ১৫ বার ভূমিকম্প হয়েছে। সুনামগঞ্জ, সিলেটের জাফলং অংশে ডাউকি ফল্টের ঝুঁকি রয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন। বিশেষজ্ঞদের অভিমত সিলেটে নগরীতে ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ ভবনই অপরিকল্পিত। তাই ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে হলেই ৮০ শতাংশ বহুতল ভবন ভেঙে পড়তে পারে।

 

সম্প্রতি তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানী ও লাখ লাখ বাড়িঘর ধ্বংশের ফলে বাংলাদেশেও বিশেষ করে সিলেটে ভূমিকম্পের বিষয়টি আবার সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে।

 

এই অঞ্চলে ভুমিকম্প হলেই সচল হয়ে ওঠে সিলেট সিটি করপোরেশন। কিছুদিন তোড়জোড়, নোটিশ, মার্কেট-বিপনীবিতান বন্ধ, ভবন ছাড়ার আল্টিমেটাম, হুমকি ধমকির পর তা আবার চাঁপা পড়ে যায়। ঝুঁকি মোকাবিলার উদ্যোগ ও নির্দেশনা আর কার্যকর হয়না। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ঠিকই ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

 

ভূতত্ত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কয়েকটি প্লেট থাকার কারণে এসব এলাকা ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে ঝুঁকি থাকলেও তা মোকাবিলায় এখানে কার্যকর তেমন কোন উদ্যোগ নেই।

 

বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষার পর ২০২১ সালের ৩০ মে নগরের ২৫টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ করে সিলেট সিটি কর্তৃপক্ষ। নগরীর তাঁতিপাড়ার একটি বাসা ভাঙা ছাড়া আর কোন অ্যাকশন চোখে পড়েনি। তবে বার বারই ঝুঁকিপূর্ণ ভবন-মার্কেটের বিরুদ্ধে ‘অ্যাকশনে’ যাবার হুশিয়ারী দেন সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ঝুঁকি নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে।

 

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) পুর ও পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মুশতাক আহমদ আশংকা করছেন, টেকটোনিক প্লেটের বাউন্ডারি সিলেটের কাছাকাছি থাকায় এ অঞ্চল ভূমিকম্পের সবচাইতে বেশী ঝুঁকিতে রয়েছে। পাশাপাশি ডাউকি ফল্ট, সিলেট ফল্ট, ত্রিপুরা ফল্টের অবস্থানও সিলেটের কাছাকাছি হওয়ায় এখানকার ঝুঁকির কারণ বেশী বলে তিনি মন্তব্য করেন।

 

এদিকে, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং (সিইই) বিভাগের জরিপ অনুযায়ী সিলেট নগরীতে প্রায় ১০০টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে। এর মধ্যে ৩২টি 'অধিক ঝুঁকিপূর্ণ' চিহ্নিত করে দুবছর আগে সে গুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সুপারিশ করা হয়েছিল।

 

প্রসঙ্গত: গত ১৬ ফেব্রুয়ারি সিলেটের নিকটবর্তী ভারতের মেঘালয় রাজ্যে রিখটার স্কেলে ৪.৩ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। সিলেটের কাছাকাছি ছাতকের ১১ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে এ ভূমিকম্প অনুভূত হয় বলে আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন। গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ভোর ৪টা ২২ মিনিটে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের কয়েকটি জেলায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে ভ‚মিকম্পটির মাত্রা ছিল ৫.৫।

 

প্রাথমিকভাবে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ভারতের মনিপুর রাজ্যের আশপাশে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া, ২০২১ সালের ১৩ এপ্রিল ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভের তথ্য অনুযায়ী-রিখটার স্কেলে সিলেট নগরীতে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৬.৯। এ ভুমিকম্পে ভয় ধরে যায় নগরবাসীর মনে।

 

আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য মতে, গত কয়েক বছরে সংঘটিত ভূমিকম্পের অন্তত ২০টির উৎপত্তিস্থল ছিল দেশের ভেতরে। যার মধ্যে ১১টির উৎপত্তিস্থল সিলেট অঞ্চলে। বাকি ২৭টি ছিল সীমান্ত এলাকাসহ আশপাশের দেশে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বারবার ভূমিকম্প হওয়ার অর্থ এখানকার ফল্টগুলো সক্রিয় আছে।

 

এ অবস্থায় নড়েচড়ে বসে সিটি করপোরেশন। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনসমূহকে দেয়া হয় নতুন করে নোটিশ। খালি করার নির্দেশ দেয়া হয় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভবন খালি করা না হলে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ভেঙে ফেলারও সতর্ক বার্তা দেয়া হয় নোটিশে। সিটি করপোরেশনের তৎপরতা ছিল আশাজাগানিয়া।

 

বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষার পর ২০২১ সালের ৩০ মে নগরের ২৫টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ করে সিটি কর্তৃপক্ষ। ওই দিনই নগরের সুরমা মার্কেট, সিটি সুপার মার্কেট, মধুবন সুপার মার্কেট, সমবায় মার্কেট, মিতালী ম্যানশন ও রাজা ম্যানশন নামের ৭টি মার্কেট-বিপণি বিতানকে ১০ দিন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়।

 

ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় মার্কেটগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। তবে কিছুদিন পর তা আবার চালু হয়। রাজা ম্যানশনের সামনের অংশ নতুন রংচং করানো হয়। রং পাল্টানো ছাড়া আর কোনো সংস্কার কাজের চিহ্ন নেই। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করলেও সেগুলো এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে। চলছে ব্যবসা বাণিজ্য।

 

এদিকে, সিলেটের ৪২ হাজার বহুতল ভবনের ভূমিকম্পের সহনীয়তা পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিল সিটি করপোরেশন। সিটি কর্মকর্তারা বলছেন, অর্থের অভাবে ভবন পরীক্ষা করানো যাচ্ছে না।

 

এ ব্যাপারে সিলেট সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, ১০টি অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবন বন্ধ করার নির্দেশনা আমরা দিয়েছিলাম। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে এগুলো সংস্কার করার জন্যও আমরা মালিকপক্ষকে বলেছিলাম। কিন্তু তারা তা শোনেননি। আবার ভবনগুলো ভাঙতে গেলে তারা আদালতে মামলা করে বসেন’। সিসিকের জরিপ অনুযায়ী বর্তমানে নগরীতে ২৭টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে।

 

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিইই বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রফেসর ড. জহির বিন আলম জানান, তাদের বিভাগের পক্ষ থেকে কয়েক বছর আগে সিলেট নগরীর শতাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সায়েন্টিফিক অ্যাসেসম্যান্ট করা হয়। এ অনুযায়ী নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৭-৩২টি ভবনকে তারা ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করেন।

 

এর মধ্যে ২৩টি ভবনকে ‘ভয়ংকর’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বাকি ভবনগুলোর মধ্যে কোনটা হেলে পড়েছে কিংবা দেবে গেছে, এগুলোর কাঠামো ঠিক করে ‘রিনোভেশন ওয়ার্ক’করতে হবে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।।

 

অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম আরও বলেন, ‘সিলেটের ভবনগুলো গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ ভবনই ভূমিকম্পের কথা চিন্তা না করে তৈরি করা হয়েছে। ফলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ৮০ শতাংশ বহুতল ভবন ভেঙে পড়তে পারে।’

 

সম্প্রতি তুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্পে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, আফগানিস্তান ও আসামে ভূমিকম্পের পর মেঘালয়ে আঘাত হানে ভূমিকম্প। এ প্রসঙ্গে আলাপকালে শাবির প্রফেসর ড. মুশতাক ঝুঁকিতে থাকা সিলেটে  ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে নতুন ভবনের ডিজাইন থার্ড পার্টি (তৃতীয় পক্ষ)-কে দিয়ে ভেটিং করানোর তাগিদ দেন। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন-এরই মধ্যে ভেটিং পদ্ধতি চালু করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, সিসিক এলাকায়ও অনুরুপ পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন।

 

সার্ভে টিমে থাকা অধ্যাপক ড. মুশতাক বলেন, নতুন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সংশি¬ষ্টদেরকে অবশ্যই কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। পর্যাপ্ত খালি জায়গা না রেখে ভবন নির্মাণ করলে ভূমিকম্পে উদ্ধার কাজ চালানো যাবে না-মানুষকে এ বিষয়টি বোঝাতে হবে, সচেতন করতে হবে।

 

ড. মুশতাক বলেন, তুরস্ক আমাদের চেয়ে উন্নত দেশ কিন্তু ভূমিকম্পের পর তারা খুবই শোচনীয় অবস্থায় আছে। এ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মানুষ ভূমিকম্পে মরে না, মানুষ নিজের তৈরী ফাঁদে পড়ে মরে অর্থাৎ বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়ে মরে।

 

তিনি বলেন, আমাদের বিএনবিসি (বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড) যথেষ্ট মানসম্পন্ন। এটা মেনে চললেও ঝুঁকি অনেকটা এড়ানো যাবে।

 

ভূমিকম্প প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বিবিসিকে বলেছেন, সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চল ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। সেখানে যে পরিমাণ চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে ৮ মাত্রার অধিক ভূমিকম্প হতে পারে।

 

তিনি বলেন, এটা যেমন একবারে হতে পারে, আবার কয়েকবারেও হতে পারে। তবে যে কোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন। কিন্তু কবে বা কখন সেটা হবে, তা এখনো বিজ্ঞানীদের এখনো ধারণা নেই। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দুই যুগ ধরে এ নিয়ে গবেষণা করেছে।

 

সেখানে দেখা গেছে, ইন্ডিয়া প্লেট ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে দীর্ঘসময় ধরে কোন ভূমিকম্পের শক্তি বের হয়নি। ফলে সেখানে ৪০০ থেকে হাজার বছর ধরে শক্তি জমা হয়ে রয়েছে।

 

বাংলাদেশে সর্বশেষ ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। ১৮৮৫ সালে ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জে ৭.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের ইতিহাস রয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/নি