অনিল সেন: রক্তের সম্পর্ক অনেক বড় হয় কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু সম্পর্ক এমনো হয় যেগুলো রক্তের বাঁধনের চেয়েও অনেক দামি- সমাজে এমন একটা কথা আছে। মজিবর আমার কাছে এমনি একজন। আমাদের মধ্যে মামা ভাগ্নে সম্পর্ক। ওর মামা ডাক শুনে বড় হয়েছি। সে ডাকে একটা আলাদা অন্তর ঝরা মাধুর্যতা আছে। ওর বয়সের সঙ্গে আমার বয়সের তেমন একটা ফারাক নেই।
কিশোর বয়সে আমি হাফপ্যান্ট পরতাম মজিবর লুঙ্গি পরত। সহজ-সরল মানুষ বলতে যা বুঝায় সে তেমনি। কথাও খুব একটা বলে না। ছোটবেলা থেকেই অনেকটাই চুপচাপ। সবকিছুকে চেয়ে চেয়ে দেখাই তার অভ্যাস। বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে খুব একটা যায় না। ঘোরাঘুরির জায়গা ধানক্ষেত আর আমাদের বাড়ি পর্যন্তই। তবে অনেক দূর দেখতে পারে। তার বসে থাকা মানে বসে থাকা নয়।
জৈষ্ঠ্যের কড়া রোদে দাঁড়িয়ে সে ভাবতে পারে অবিচল। আষাঢ়ের ঝমঝম বৃষ্টি বয়ে যায় তার শরীরজুড়ে। গন্ধ শুঁকে প্রখর রোদের শব্দ। একা একা অনেক দামি কথা বলতে পারে সে! তখন তার সঙ্গী সে নিজেই। জমির নরম মাটি থেকে যেন কী একটা সংগ্রহ করে। বাড়ির পশুগুলোর সঙ্গেও তার একটা নিবিড় সম্পর্ক তৈরি আছে। কুকুর, বিড়াল, ঘুঘু তার কথা দিব্যি শোনে। চতুর্মাত্রিক তার অন্তর-প্রকৃতি।
মজিবরের সরলতা বিরল। তবে ওর কাছে একটা পছন্দের মাপকাঠিও আছে। যাকে অপছন্দ করে তার পাশে ভিড়ে না। সে একদিন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। তার তোতলানোর স্বভাব আছে। রাগ আর আবেগের সময় সেটা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। মজিবর বলল, মামা তোমরা নাকি হালখাতা করবার যাইবেন, তোমার সথে মুইও যাইম। আব্বা তোমার সাথে যাবার কইছে। আমি বললাম, আমি তো ওসবে যাই না। তোর দাদু যায়। মজিবর নাছোড়বান্দা।
আমরা বাইসাইকেলে রওনা দিলাম। সঙ্গে ভবেনসহ আরো কয়েকজন। মাইকের আওয়াজ শুনে মজিবর টের পেল আমরা পৌঁছে গেছি। কবিরাজ সাহেব হাতমুখ ধুয়ে ভেতরে বসতে বললেন। আমরা বকেয়া শোধ করলাম। আমাদের সামনে গরম জিলাপির প্লেট। মজিবর আর অপেক্ষা করতে পারল না। আমরা শুরু করার আগে তার প্লেট খালি। মিষ্টি তার খুব পছন্দের। আরো খাবে! আঙুল চুষছে। আমার প্লেট থেকে তুলে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় কবিরাজ সাহেবের বড় ছেলে বললেন, ভাই তুমি খাও আমি ওকে আরো দিচ্ছি। মজিবর বাকিকটাও গবগব করে খেয়ে নিল।
খাওয়া শেষ। এবার চা পানের পালা। মজিবর কোনোদিন চা খায়নি। আজ খাবে বলে আমাকে আগেই জানিয়েছে। সামনে চায়ের কাপ। ধোঁয়া উঠছে। সে কানে কানে বলল, মামা চা কেমনকরি খায়? আমি বললাম, পানির মতো করে খায়! মজিবর পানি খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিল। প্রায় অর্ধেক চা তার মুখের ভেতরে!
মজিবর ‘ও বাপরে-মারে’ করে উঠল। সবাই ছুটে এলো। এক হুলস্থ‚ল ব্যাপার। আমরা খেই হারিয়ে ফেললাম ব্যাপারটা কী হলো! তার অবস্থা দেখে আমাদের হাসি-কান্না একসঙ্গে বন্ধ হওয়ার জোগাড়। কী আর করা মজিবরকে গ্লাসের পর গ্লাস নলক‚পের ঠান্ডা পানি খাওয়ানো হলো। তার মুখের ভেতরের অনেকটা ঝলসে গেছে। খানিকক্ষণ মুখটা হাঁ করে রাখল। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো। মনে মনে ভাবলাম, সে কতই না কষ্ট পাচ্ছে।
মজিবর আর একটা মুহূর্ত দেরি করল না। আমাদের ছেড়ে সে হেঁটেই বাড়ির দিকে রওনা দিল। সবাই ডাকছে, শুনছে না। ধান ক্ষেতের আল ধরে দ্রুত হেঁটে চলছে তো চলছেই। ঠিক বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে আমরা তার মুখোমুখি হলাম।
সে মুচকি হেসে আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, এইটা ক্যাদন হইল মামা, মোক গরম চা খোয়ালেন! ভবেন খসখসে হাসি দিয়ে বলল, চা ঠান্ডা খায় নাকি বোকা! মজিবর মুখে হাত চাপা দিয়ে ‘উহ্’ শব্দ করে চলে গেল! আমি বললাম, তোমরা হাসি বন্ধ কর।
ভোরের আকাশ/নি