মো. এনাম উল ইসলাম: আজ ২৫ মার্চ ২০২০, এ মাস নিয়ে শফিকের পাঁচ মাসের বেতন বকেয়া পড়েছে। শফিক একটি পোশাক প্রস্তুতকারী ফ্যাক্টরি অর্থাৎ গার্মেন্সে এইচ আর অ্যাডমিন ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত। প্রত্যেক মাসেই যখন ওয়ার্কারের বেতন দেয়া হয়, তখনই মালিকের অফিস স্টাফদের বেতনের আর টাকা হয় না, কম পড়ে যায়।
তারপরই শুরু হয় মালিকের অনুরোধ, আপনারা আর কয়টা দিন সবুর করেন, আরে আপনারা তো আমারই লোক। এই তো আগামী সপ্তাহে একটা বিল পাওয়ার কথা আছে ওই টাকাটা পেলেই আপনাদের সবার টাকা দিয়ে দিব ভাই। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, টাকা পাওয়ার পরই ইলেকট্রিক বিল, গাস বিল, ওভারটাইম, ফ্যাক্টরি ভাড়া ইত্যাদি দিতে দিতে আবার অফিস স্টাফদের ভাগ্যে মূলাটি ছাড়া আর কিছুই জোটে না।
বন্ধু-বান্ধব যে শোনে সেই বলে, বলেন কি? চাকরি ছাড়েন না কেন? কিন্তু শফিক কী করবে হুট করে একটা সুবিধামতো কাজ পাওয়া বর্তমানে খুবই কঠিন। তাছাড়া অধিকাংশ ফ্যাক্টরির যে একই হাল। শফিক আজ তার মনটাকে শক্ত করেছে এমডি মিস্টার মাসুদ আহমেদ এলে কথা বলবে। সে সিকিউরিটিতে ফোন করে জানতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে জবাব এলো এমডি স্যার তো আরো আধা ঘণ্টা আগে এসেছেন।
তাই ? শফিকের বিস্ময়।
শফিক আর দেরি না করে এমডি সাহেবের রুমের দিকে রওনা দিল।
দরজা ঠেলে আসসালামু আলাইকুম, আসব স্যার?
আরে শফিক সাহেব আসুন আসুন। কিছু বলবেন?
স্যার, আমরা ক’জন মাত্র স্টাফ আজ পাঁচ মাস বেতন পাই না। আমরা তো আর চলতে পারছি না স্যার। আমাদের বাসাভাড়া দিতে হয়, বাচ্চাদের স্কুল-কলেজের বেতন বকেয়া, দোকানে বাকি খাই সেখানে বাকি পড়ে আছে। স্যার আমাদের জন্য একটা কিছু করেন প্লিজ!
মাসুদ আহমেদ পকেট হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটি বেনসন লাইট বের করে ঠোঁটে দিয়ে আগুন ধরালেন। টান দিয়ে এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে বললেনÑ আমি বুঝি, সব বুঝি। আপনারা যে কষ্টে আছেন তাও জানি, কিন্তু কী করি বলেন তো? একটু ধৈর্য ধরেন আর কয়টা দিন ।
স্যার, বোঝেন একটু, পাঁচটা মাস আমরা বেতন পাই না, কীভাবে ধৈর্য ধরতে পারি? মাসুদ আহমেদ মাথা নিচু করে টেবিলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এমন সময় বায়িং অফিসের দুজন লোক ঢুকলেন। মাসুদ আহমেদের সুযোগ হলো প্রসঙ্গ পাল্টানোর। তিনি বললেন, ঠিক আছে আমি দেখছি কী করা যায়।
শফিক মাথা নিচু করে রাজ্যের গ্লানি নিয়ে মুখ কালো করে বের হয়ে এলেন। সহকর্মী তৌফিক, হিরা, আতিক আরো কয়েকজন বাইরে অপেক্ষা করছিল, শফিককে বের হতে দেখে এমডি সাহেব কী বললেন জানতে চাইল। বিরক্তি মুখে শফিক উত্তর দিলেন ওই দেখতেছি ।
সাব্বির একেবারে সবার জুনিয়র। বেচারা জয়েন করার পর এক মাসের বেতনও সঠিক সময়ে পায়নি। সে অনেক কষ্টের স্বরে বলল জানেন স্যার, আমার পকেটে বাজার করার মতো একটা টাকাও নেই। উপরন্তু আমার স্ত্রী প্রেগন্যান্ট। শফিক সাহেব আর কিছুই বলতে পারলেন না।
২৬ মার্চ এবং ২৭ মার্চ দুদিন ছুটি, কারো কাছে যে টাকা ধার চাইবে তারও ওপায় নেই। চাকরি পেলে নাকি আত্মীয়স্বজন, বাবা-মা খুশি হয়। যে না ছেলেটার এতদিন বাদে একটা হিল্লে হলো। কিন্তু হায় খোদা! এ তোমার কেমন বিচার! রাতে বাসায় এসে টেলিভিশনের খবর দেখে শফিকের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। করোনাভাইরাসের জন্য প্রথম দফার লকডাউন ঘোষণা হয়েছে। অফিস-আদালত-গাড়ি সবকিছু বন্ধ। পুরো এপ্রিল মাস চলে গেল লকডাউনে, মে মাসের মাঝামাঝি সহকর্মী আতিকের ফোন...
হ্যাঁ আতিক সাহেব বলেন, শুনছি। শফিকের কানে ফোন।
স্যার, এমডি স্যার তো ফ্যাক্টরির মেশিনপত্র বিক্রি করে দিয়েছে, ২/১ দিনের মধ্যে ওয়ার্কারদের বেতন দেবে শুনলাম, সামনে ঈদ, ওয়ার্কারদের টাকা না দিলে তো আবার আন্দোলন। তাই ভয়ে এ পদ্ধতি।
ওয়ার্কারদের দেবে, আর আমাদের? আমাদের যে পাঁচ মাস বাকি? নাকি স্টাফ আন্দোলন করে না মুখ বুজে থাকে বলে ?
আমাদের নাকি এক মাস দেবে। আতিকের উত্তর।
এক মাস? বলেন কি? পাঁচ মাস সমান এক মাস? আসলে কোনো ইনসাফ নেই বুঝলেন?
আতিক সাহেবের বাসা ফ্যাক্টরি-সংলগ্ন, তাই যে কোনো কাজে তাকে ডাকে। সে সুবাদে সে আমাকে জানায়।
দু-চার দিন বাদেই আবার আতিক সাহেবের ফোন।
আসসালামু আলাইকুম স্যার।
ওয়ালাইকুম আসসালাম, আতিক সাহেব কেমন আছেন?
ভালো আছি স্যার, স্যার আজ তো ওয়ার্কারদের এক মাসের টাকা দিয়ে সবাইকে বলেছেন আর তিনি দিতে পারবেন না, তারা যেন দয়া করে এটা নিয়ে খুশি থাকে। ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিয়েছে।
আর আমাদের? শফিকের প্রশ্ন।
আমাদেরও এক মাস করে দিয়েছে। আপনি তো দূরে থাকেন। স্যার আপনার টাকা আমার কাছে আছে। আমি কি বিকাশ করে দেব?
কী করা, করেন বিকাশ আমার নম্বরে। আতিক কি বলল শফিক যেন তা কিছুই শোনেনি।
জি¦ স্যার। ধন্যবাদ। আতিক ফোন রেখে দেয়।
শফিকের বুকটা কেমন জানি ভারি হয়ে আসছে, সে বাসায় এখনো কাউকে কিছু বলেনি। কারণ সবাই চিন্তা করবে ভীষণ। একটা ছেলে কলেজে পড়ে, সে আরো বেশি চিন্তা করে। লকডাউনের মধ্যে এই যে লকডাউন হলো এর খবর ক’জনে রাখে? এ যন্ত্রণা কি মুখ ফুটে বলা যায় ? যায় না...
শুধু মনে পড়ে সুনীলের সেই ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতার লাইন।
‘বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই’।
ভোরের আকাশ/নি