ইমরান আলী, রাজশাহী থেকে ফিরে: হেরোইনের গেটওয়েখ্যাত গোদাগাড়ীর গডফাদারদের চোখ পড়ে কলেজছাত্রী মুক্তির ওপর। সবে স্কুল পেরিয়ে কলেজের প্রথম বর্ষের মুক্তি দেখতেও সুন্দরী। সংস্কৃতিমনা টিনএজ মুক্তির ওপর টার্গেট করে সফলও হয় মাদক ব্যবসায়ীরা। নানা ছলে-কৌশলে এমন ফাঁদ পাতা হয় হেরোইন বহনের কাজে রাজি হয়ে যায় মুক্তি। মাস চারেক আগে ৩০০ গ্রামের একটি চালান পাচারের সময় র্যাবের হাতে ধরা পড়ে মুক্তি।
একমাত্র মেয়ের এমন কান্ডে হতভম্ব হয়ে যায় পরিবার। উপজেলা মৎস্য অফিসের অফিস সহকারী মোখলেসের পরিবারে নেমে আসে অন্ধকার। আদরের একমাত্র মেয়ে মুক্তি এখন কারাগারে। যে মুক্তির সঙ্গে আনন্দসময় পার করতেন মা, সেই মা এখন শোকে পাথর। হেরোইনের ছোবলে প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে মনোয়ারা বেগম। গোদাগাড়ী থানার ঠিক দক্ষিণেই রামনগর এলাকা। পদ্মার তীরের পাড়। সেখানেই গিয়ে কথা হয় মুক্তির মা মনোয়ারার সঙ্গে। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতেই গলা যেন ধরে যায় তার। একরকম পাথর হয়ে গেছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘ফিশারিজ মোখলেসের পরিবার (মুক্তির বাবা) কেমন কে-না জানে। কিন্তু মেয়ে এরকম হবে কল্পনায়ও ছিল না।’ কারা নষ্ট করল তার সন্তানকে এমন কথায় চোখে পানি চলে আসে মনোয়ারার। তিনি বলেন, ‘কারা নষ্ট করল আমার মেয়েকে, আমি তাদের বিচার চাই। মেয়ে তো আমার এরকম ছিল না। কেন এমন হলো।’ রাজশাহী শহর থেকে ৩০-৩৫ কিলোমিটার পশ্চিমে গোদাগাড়ী উপজেলা।
পদ্মার কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সীমান্তঘেঁষা উপজেলাটি যেমন কৃষিপণ্যের জন্য বিখ্যাত, তেমনি মাদক তথা মরণনেশা হেরোইনের ‘গেটওয়ে’ হিসেবে সারা দেশে পরিচিত। কক্সবাজারের টেকনাফে যেমন নদীর স্রোতের মতো ইয়াবা দেশের অভ্যন্তরে আসে, ঠিক তেমনি উপজেলার অন্তত ১০টি সীমান্ত গলিয়ে হেরোইন দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। দেশের যে কয়েকটি সীমান্ত পেরিয়ে হেরোইন আসে, তার মধ্যে এ গোদাগাড়ী অন্যতম অর্থাৎ প্রায় ৯০ শতাংশ হেরোইন এ সীমান্ত দিয়ে আসে।
আর হেরোইনের গডফাদাররা তা পাচারের জন্য নানা কৌশল ব্যবহার করে। তাদের পাতা ফাঁদ থেকে নারী, শিশু; এমনকি স্কুলছাত্রীও বাদ যায়নি। হেরোইনের এ ফাঁদে পড়ে একদিকে যেমন সংসার তছনছ হয়ে গেছে; অন্যদিকে সমাজ তথা লোকজনের কাছে হয়ে গেছে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে। অনেকে বছরের বছর জেলে খেটে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতেও পারেননি। কারবারিরা নগদ টাকার লোভ দেখিয়ে নারীদের দিয়ে বাহনের কাজে ব্যবহার করছে। আর এতে করেই তাদের জীবনে নেমে আসছে অন্ধকার।
স্বামীহারা সংসার চালাতে যখন হিমশিম খাচ্ছিলেন, এ সময় স্থানীয় এনজিও থেকে ঋণ নেন একই গ্রামের সুলতানা। ঋণের কিস্তি পরিশোধেও পড়েন বেকায়দায়। এ অবস্থায় ধারদেনা করতে গেলে প্রস্তাব পান হেরোইন পাচারের। অন্যায় এবং বিপজ্জনক হওয়া সত্তেও রাজি হয়ে যান তিনি। পরে হেরোইন নিয়ে রাজশাহী থেকে রংপুরে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরাও পড়ে যান। বর্তমানে কারাগারে থাকা সুলতানার বাড়িতে গেলে দেখা মেলে তার ছেলে বাপ্পির।
বাপ্পি জানান, সংসারে ঋণের টাকা কিস্তির জন্য তাদের সমস্যা হচ্ছিল। এ কারণে মা এ কাজে জড়িয়েছেন। নগদ টাকার জন্যই অন্যায় জেনেও মা রাজি হয়ে যান। তিনি জানান, মা বর্তমানে কারাগারে। এখন বুঝছি মায়ের এ কাজে জড়ানো ঠিক হয়নি। মায়ের মামলা চালাতেও আমরা হিমশিম খাচ্ছি। সুলতানগঞ্জের মুক্তিরও অবস্থাও ছিল একই রকম। লোভের বশবর্তী হয়ে কারবারে জড়িয়ে এখন তিনিও কারাগারে।
মুক্তি কিংবা সুলতানাই নন, গোদাগাড়ীতে শতাধিক নারী কেউবা কারাগারে কেউবা কারাগার থেকে জামিনে রয়েছেন। কারবারিরা আড়ালে থেকে নানা প্রলোভন কিংবা ফাঁদে ফেলে ভয়ংকর রাস্তায় নামিয়ে দিচ্ছে। আর এতে করেই একসময়ের সুশৃঙ্খল জীবনে নেমে আসছে অন্ধকার।
হেরোইন আসা ১০ সীমান্ত : উপজেলার ১০টি সীমান্ত দিয়ে দিনে রাতে হেরোইন আসে বলে জানা যায়, পদ্মায় মাছ ধরা নৌকা কিংবা চর এলাকায় মোটরসাইকেল ব্যবহার করে কারবারি সীমান্ত গলিয়ে দেশে আনছে। এ সীমান্তগুলো হলো মহিষালবাড়ী, বিদিরপুর, বখচর, চর আষাড়িয়াদহ, চর অনুপনগর, দেবিনগর, ফুলতলা, কামারপাড়া, সুলতানগঞ্জ, রেলবাজার ঘাট।
লোকজন বলছেন, কারবারিরা টাকা লাগিয়ে বসে থাকে। বাকি কাজগুলো তাদের এজেন্টরা। সীমান্তের ওপার থেকে এপারে আনাতে একজন দায়িত্বে থাকে। আবার এপারে আনার পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাচারের জন্য অন্য এজেন্ট। আর এ এজেন্টরা একেক কৌশল ব্যবহার করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সীমান্তে পাচার করে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে অত্যন্ত সুকৌশলে তারা এ কাজ করছে।
কিন্তু র্যাব পুলিশের অতি সতর্কতার ফলে তারা ধরাও পড়ে যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১০০ গ্রাম হেরোইন গোদাগাড়ী থেকে রাজশাহী পর্যন্ত পৌঁছালেই ১০ হাজার টাকা দেয়া হয়। এরপর ঢাকা পর্যন্ত নিয়ে যেতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত বাহককে দেয়া হয়। নগদ টাকার এ লোভে পড়েই নারী, শিশুসহ অন্যরা এ কাজে জড়িয়ে পড়ছে।
স্থানীয় শিক্ষক রেজাউল করিম বলেন, আমরা এখন নিজেদের গোদাগাড়ী এলাকার বাসিন্দা বলতেই লজ্জা করি। বর্তমানে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, ভালো আর কে মাদক ব্যবসায়ী এটা নির্ণয় করা কঠিন। একজন স্কুলশিক্ষক হয়েও অনেক সময় আমাকে তল্লাশির আওতায় পড়তে হয়। এটা আমার জন্য লজ্জাস্কও, অমানকর।
তিনি বলেন, এটি খুবই উদ্বেগের যে এখন গৃহবধূ থেকে শুরু করে স্কুলের ছাত্রীরাও এ কাজে জড়িয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, আসলে টাকা কামানোর প্রতিযোগিতায় কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায় কিছুই দেখা হচ্ছে না। আর এ কারণে এমন পরিস্থিতি। রেজাউল করিম বলেন, আসলে আমাদের মধ্যে ধর্মের চেতনা জাগ্রত করতে হবে। ধর্মের চেতনা জাগ্রত হলেই শুধু এসব অন্যায় বেআইনি কাজ বন্ধ হবে।
এদিকে রাজশাহীর পুলিশ সুপার মাসুদ হাসান বলেন, নারীরা যে এমন কাজে জড়াচ্ছে এটি উদ্বেগের। তবে যার কাছেই পাওয়া যাবে আমরা তাদেরই গ্রেপ্তার করবো এবং আইনের আওতায় আনব। তিনি বলেন, শুধু বাহক নয়, মূল কারবারিদেরও আমরা গ্রেপ্তার করছি।
ভোরের আকাশ/নি