logo
আপডেট : ৪ মার্চ, ২০২৩ ১০:২৭
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল
মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ

বঙ্গবন্ধুর ডাকে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চের প্রতিটি দিন ছিল ঐতিহাসিক। প্রতিটি দিন ছিল ভয়-ভীতি আর প্রত্যাশায় ভরপুর। একদিকে বাঙালি জাতির নতুন দেশের হাতছানি। অন্যদিকে সব হারোনোর ভয়। ১৯৭১ সালের ৪ মার্চ। সেদিন কী ঘটেছিল।

 

এ নিয়ে অনেকেরই এখন জানার আগ্রহ আছে। উত্তাল মার্চ মানেই যুদ্ধ শুরু। আস্তে আস্তে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। চলছে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ। থেমে নেই পাকিস্তানি বাহিনীও। তারা নেমে পড়ে দমন-পীড়নে।

 

বাঙালির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন। জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা ও গণহত্যার প্রতিবাদ কর্মসূচিতে পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের বেসামরিক শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ঢাকাসহ সারা বাংলায় সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ঢাকায় কারফিউ তুলে নেয়া হয়। খুলনা ও রংপুরে কারফিউ বলবৎ রাখা হয়।

 

বঞ্চনার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা বাঙালির ওপর হামলে পড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও ইপিআর। হরতাল চলাকালে খুলনায় সেনাবাহিনীর গুলিতে ছয়জন শহীদ হন। চট্টগ্রামে দুদিনে প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়ায় ১২১ জনে। যশোরে সেনাবাহিনীর গুলিতে মিছিলে চারুবালা ধর শহীদ হন। জনতা লাশ নিয়ে মিছিল বের করে। প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের জল-স্থল-আকাশপথ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

 

আন্দোলন কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তার ধারণা পাওয়া যায় মওলানা ভাসানীর বিবৃতি থেকে। তিনি এদিন এক বিবৃতিতে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সাত কোটি বাঙালির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের দাবি জানান।

 

তিনি বলেন, ‘কংগ্রেস, খেলাফত, মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের মাধ্যমে বহু আন্দোলন করেছি, কিন্তু আমার এই ৮৯ বছর বয়সে এবারকার মতো গণজাগরণ ও সরকারের অগণতান্ত্রিক ঘোষণার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ বিক্ষোভ আর দেখিনি।’ তিনি এ বিষয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে তারবার্তাও পাঠান।

 

রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, চরম ত্যাগ স্বীকার ছাড়া কোনো দিন কোনো জাতির মুক্তি আসেনি। তিনি উপনিবেশবাদী শোষণ ও শাসন অব্যাহত রাখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহব্বানে সাড়া দেয়ায় বীর জাতিকে অভিনন্দন জানান।

 

বঙ্গবন্ধু ৫ ও ৬ মার্চ সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালনের আহব্বান জানান। একই সঙ্গে তিনি ঘোষণা করেন, ‘যেসব সরকারি ও বেসরকারি অফিসে কর্মচারীরা এখনো বেতন পাননি, শুধু বেতন প্রদানের জন্য সেসব অফিস আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত খোলা থাকবে।’

 

এই সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ এক হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেতনের চেক ভাঙানো যাবে এবং শুধু বাংলাদেশের মধ্যে ব্যাংকের লেনদেন করা যাবে বলেও নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুর আহব্বানের পর স্বাধিকার আন্দোলনে গুলিতে আহত মুমূর্ষু বীর সংগ্রামীদের প্রাণরক্ষার জন্য শত শত মানুষ, ছাত্র-ছাত্রী ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ব্লাড ব্যাংকে স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন।

 

স্বাধিকার আন্দোলনের জোয়ার ছড়িয়ে পড়ে নানা দিকে। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র হয়ে যায় ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’। পাকিস্তান টেলিভিশন হয়ে যায় ‘ঢাকা টেলিভিশন’। নতুন পরিচয় দিয়ে শুরু হয় সম্প্রচার। বেতার- টেলিভিশনের শিল্পীরা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানান। তারা ঘোষণা করে ‘যত দিন পর্যন্ত দেশের জনগণ ও ছাত্রসমাজ সংগ্রামে লিপ্ত থাকবে, তত দিন পর্যন্ত বেতার ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তারা অংশ নেবেন না। ’

 

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ করে একই সঙ্গে তার হাতে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক সামরিক প্রশাসকের ক্ষমতাও অর্পণ করেন। প্রেসিডেন্ট ৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন বলে বেতার-টিভিতে ঘোষণা করা হয়।

 

ভোরের আকাশ/নি