logo
আপডেট : ৪ মার্চ, ২০২৩ ১০:৩৯
লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি বিএনপির
এম সাইফুল ইসলাম

লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি বিএনপির

এম সাইফুল ইসলাম: ১০ দফা দাবিতে তৃণমূলে; বিশেষ করে ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে নতুন করে মামলায় বিপর্যস্ত বিএনপি নেতাকর্মীরা। অনেকে ক্ষেত্রে স্থানীয় আওয়ামী লীগের রোষানলে পড়ে অনেকে এখন এলাকাছাড়া।

 

তৃণমূলের নেতারা বলছেন, ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে তাদের লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়েছে। তাই সরকার পতনের ‘চূড়ান্ত আন্দোলন’র আগে আপাতত ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মসূচি পালন না করাটা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হবে বলেও মনে করেন তারা। যদিও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, কর্মসূচির মাধ্যমে তৃণমূল জাগ্রত হয়েছে।

 

আগামীতে কঠোর আন্দোলনের আগে এসব কর্মসূচি ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে নিয়েছেন তারা। তবে মামলায় নেতাকর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন স্বীকার করে তারা বলছেন, মামলা দেয়া আওয়ামী লীগের পুরোনো কৌশল। মামলার ভয়ে কর্মসূচি বন্ধ করা যাবে না।

 

যশোর সদর উপজেলার নওয়াপাড়া ইউনিয়নের ঘুরুলিয়া গ্রামের ৮নং ওয়ার্ড বিএনপির সেক্রেটারি আক্কাস আলী। পেশায় তিনি একজন কৃষক। তিনি জানান, গত ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশের আগের ডামাডোলে তাকে গ্রেপ্তার করে নাশকতা মামলায় আসামি দেখিয়ে চালান দেয় পুলিশ। এক মাসের বেশি জেলে থাকার পর তিনি জামিনে মুক্ত হন। এরপর কয়েকদিন তিনি বাড়িতে অবস্থান করেন। পরপরই গত ১১ ফেব্রুয়ারি বিএনপি ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রা কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়।

 

কেন্দ্রীয় বিএনপির ওই ঘোষণার পর আবারো শুরু হয় ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের পুলিশি হয়রানি। পরপরই তার নামে আরো দুটি নাশকতা মামলা হয়। উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিলেও তিনি এলাকায় ফিরতে পারেননি। কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, স্থানীয় ক্যাম্প পুলিশ প্রতিদিন তাকে আটকের জন্য বাড়িতে যায়। মামলা না থাকলেও পার্শ্ববর্তী তালবাড়িয়া গ্রাম থেকে কয়েকজনকে ধরে পুরোনো মামলায় চালান দেয়া হয়েছে। তাই ভয়ে তিনি এখনো এলাকাছাড়া।

 

তিনি বলেন, পুলিশের থেকেও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বেশি ঝামেলা করছে। আমাদের এলাকায় দেখলেও তারা পুলিশকে ফোন দেয়।

 

সাতক্ষীরা জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম রেজা ভোরের আকাশকে বলেন, মহানগর ও জেলা পর্যায়ের পদযাত্রা কর্মসূচি ঠিক ছিল। তবে ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত।

 

তিনি বলেন, জেলা বা বিভাগীয় শহরে কর্মসূচি পালন করলেও ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড থেকে নেতাকর্মীরা অংশ গ্রহণ করলেও খুব একটা সমস্যা হয়নি। তবে ইউনিয়ন কর্মসূচি পালন করতে গেলে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ কর্মীরা মিলে নেতাকর্মীরা হয়রাণি শুরু করেছে।

 

তিনি বলেন, ওয়ার্ডে পদযাত্রার পর সাতক্ষীরার তৃণমূল বেশ ক্ষতিগ্রস্ত। কেদ্রের কর্মসূচি পালন করতে আমাদের যত বাধায় আসুক সমস্যা নেই। তবে আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার আগে একেবারে তৃণমূলের কর্মসূচিতে লাভের থেকে ক্ষতি বেশি হচ্ছে।

 

বিষয়টি নিয়ে যশোরের মনিরামপুর উপজেলা বিএনপির আহব্বায়ক  ও সাবেক পৌর মেয়র অ্যাডভোকেট শহীদ মো. ইকবাল হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে তার উপজেলায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত তৃণমূল। প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে মামলা হয়েছে।

 

তিনি বলেন, আন্দোলন একটা চূড়ান্ত পর্যায়ে আসার আগে ইউনিয়ন বা ওয়ার্ডে; এমনকি উপজেলায়ও বিশেষ কর্মসূচি পালন না করাটা উত্তম। সব কর্মসূচি তার উপজেলায় সক্রিয়ভাবে পালন হয় দাবি করে তিনি আরো বলেন, একটা পর্যায় না আসা পর্যন্ত নেতাকর্মীদের নামে মামলার সংখ্যা বাড়লেও অনেকে কর্মসূচি আসতে কিছুটা হলেও আগ্রহ হারায়। আশা করছি, কেন্দ্র সেটি বিবেচনায় নেবে।

 

জানা গেছে, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ কয়েকটি দাবিতে আন্দোলনমুখী বিএনপি ২০২২ সালের জুলাই থেকেই ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচিতে মাঠে আছে।

 

বিশেষ করে জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে দৃঢ়ভাবে মাঠে ছিল রাজপথের এই বিরোধী দল। একইসঙ্গে ভোটাধিকার হরণসহ দলীয় নেতাকর্মীদের দমন-পীড়ন ইস্যুও ছিল। সারা দেশে বিএনপি এসব ইস্যুতে মহানগর, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড; এমনকি ইউনিট ও হাটবাজারে কর্মসূচি পালন করে।

 

এসব কর্মসূচি পালনের পর নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ১০টি সাংগঠনিক বিভাগে সমাবেশে করে বেশ চাঙা হয় বিএনপি। এসব সমাবেশের বেশিরভাগই নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি ছিল। তবে আলোচনার তুঙ্গে ছিল ১০ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশ।

 

নয়াপল্টনে সমাবেশকে কেন্দ্র করে ৭ ডিসেম্বর বিএনপি অফিসের সামনে পুলিশ ও নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির কয়েকশ’ নেতাকর্মী গ্রেপ্তারসহ নানা ঘটনার জন্ম হয় ওই সমাবেশে ঘিরে।

 

অবশেষে ১০ ডিসেম্বর গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশে থেকে আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারের পদত্যাগসহ ১০ দফা দাবি ঘোষণা করে বিএনপি। এসব দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বিএনপিসহ তাদের সঙ্গে সরকার বিরোধী আন্দোলনে শরিক হওয়া দলগুলো এখন যুগপৎভাবে মাঠে রয়েছে। কয়েকটি জোট, দল ও সংগঠন এখন বিএনপির সঙ্গে এ আন্দোলনে যুক্ত। বিএনপি ও তার শরিকরা এখন পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করছে।

 

ইতোমধ্যে দলটি ঢাকাসহ সব মহানগর, জেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মসূচি পালন করেছে। আজ শনিবার আবারো মহানগরের থানায় থানায় দলটি পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করছে। তবে ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মসূচি দলটির নেতাকর্মীদের আলোচনা স্থান পেয়েছে মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে।

 

তৃণমূলের নেতারা বলছেন, ডিসেম্বর নাগাদ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নভেম্বরে তফসিল হতে পারে। নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হলে বিএনপিকে আগামী জুন বা জুলাইকে আন্দোলনের রোডম্যাপ ধরে মাঠে নামতে হবে।

 

তারা বলছেন, একেবারে শেষ মুহূর্তে ‘বিশেষ আন্দোলন’ যখন শুরু হবে, তখন ওয়ার্ড, ইউনিয়নসহ সর্বত্র আন্দোলন করতে হবে। তার আগে তারা তৃণমূলে কর্মসূচি চান না। তারা বলছেন, এখন ঢাকাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

 

কারণ আন্দোলনে সফলতা পেতে হতে হলে ঢাকা জনসমাগম ঘটানোর কোনো বিকল্প নেই। তবে জেলা পর্যায়ের বা কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, তৃণমূলের কর্মসূচি অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক ছিল। বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও যশোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, মামলায় নেতারা কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ওই কর্মসূচির মাধ্যমে তৃণমূল জেগে উঠেছে।

 

আর মামলা দিয়ে নেতাকর্মীদের হয়রানি আওয়ামী লীগের পুরোনো কৌশল। গত ১১ ফেব্রæয়ারির ইউনিয়নে পদযাত্রা পালনের পরপরই সারা দেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের নামে হওয়া মামলার সংখ্যা কত জানতে চাইলে বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বলতে না পারলেও তিনি বলেন, প্রতিদিন অসংখ্য মামলা হচ্ছে।

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি, গণতন্ত্রের মুক্তি ও দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনের দাবিতে দল আন্দোলনে আছে। সময় বুঝে এবং জনগণের চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়েই কর্মসূচি দেয়া হচ্ছে। তৃণমূলের কর্মসূচিতে নেতাকর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত একেবারে হয়নি, তা আমি বলছি না।

 

সব কর্মসূচিতে চ্যালেঞ্জ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলছেন, চূড়ান্ত আন্দোলনের আগে মাঠ গোছাতেই তৃণমূলের ভিত শক্ত করতেই নানা পদক্ষেপের অংশ হিসেবেই এসব কর্মসূচি। এদিকে রমজান শুরুর আগেই বিএনপি ঢাকায় আরেকটি বড় কর্মসূচি চিন্তাভাবনা করলেও দলটি সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছে।

 

জানা গেছে, বড় কর্মসূচি পালন করতে গেলে ১০ ডিসেম্বরের আগের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে পরে। তাই এখন সহিংসতা এড়িয়ে শান্তিপূর্ন কর্মসূচি পালনে জোর দিচ্ছে বিএনপি। যার অংশ হিসেবে দলটি পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করছে।

 

ভোরের আকাশ/নি