logo
আপডেট : ৬ মার্চ, ২০২৩ ১০:৩৩
পঞ্চগড়ে ভুয়া তথ্য ছড়ানোয় গ্রেপ্তার ১৮
ফেসবুকে গুজব ছড়ালে গ্রেপ্তারের নির্দেশ
ইমরান আলী

ফেসবুকে গুজব ছড়ালে গ্রেপ্তারের নির্দেশ

ইমরান আলী: ফেসবুকে গুজব ঠেকাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ফেসবুকের মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির চক্রান্ত হচ্ছে উল্লেখ করে ইতোমধ্যে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তাদের নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।

 

পঞ্চগড়ে কাদিয়ানি সম্প্রদায়ের সালনা জলসাকে কেন্দ্র করে ফেসবুকের বিভিন্ন আইডি থেকে গুজব ছড়ানো হয় বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। শনিবার রাতেও গুজব ছড়িয়ে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। রোববারও সেখানে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।

 

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, পঞ্চগড়ে সহিংসতার পেছনে ফেসবুকে গুজব বড় ভূমিকা পালন করেছে। এটিকে ঘিরে চলছে নানা চক্রান্ত। তবে ফেসবুকে যে আইডি থেকে এ ধরনের গুজব ছড়ালে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। বর্তমানে গুজব ছড়ানো আইডি চিহ্নিতের কাজও শুরু হয়েছে পাশাপাশি নিবিড়ি পর্যবেক্ষণও করা হচ্ছে।

 

সূত্রে জানা যায়, পঞ্চগড়ের আহম্মদ নগরে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ৩ দিনব্যাপী সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে গত শুক্রবার বিক্ষোভ মিছিল করে ইসলামী আন্দোলনসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এ সময় মিছিলে বাধা দেয়ায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুজন নিহত হন। এদিকে এ ঘটনার পরদিন শনিবার সারা দিন পরিস্থিতি শান্ত ছিল।

 

কিন্তু রাত ৮টার দিকে কাদিয়ানিরা দুজনকে হত্যা করেছে বলে ছড়ানো হয় গুজব। এটি ছড়িয়ে পড়ার পর শহরে আবার উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। শহরের ট্রাকস্ট্যান্ড এলাকায় ভাঙচুর, লুটপাটের ঘটনা ঘটে। উত্তেজিত কিছু ব্যক্তি মাইক্রোবাসে আগুন লাগিয়ে দেয়। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে।

 

বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দেয়া ইন্টারনেট সেবাও। সদর থানার ওসি আব্দুল লতিফ মিঞা জানান, যুবদলের যুগ্ম আহব্বায়ক ফজলে রাব্বি শহরের বিভিন্ন স্থানে গুজব ছড়ায় যে কাদিয়ানিরা জবাই করে দুজনকে হত্যা করেছে। যেটি ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাকেসহ ভাঙচুর ও লুটপাটের সঙ্গে জড়িত আরো ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

 

আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সালানা জলসার মিডিয়া সেলের মাহমুদ আহম্মেদ সুমন বলেন, কে বা কারা মিথ্যা গুজব ছড়াচ্ছে, আমাদের লোকজন নাকি কাউকে মেরে ফেলে রেখেছে। গুজবকে কেন্দ্র করে আমাদের বাড়িঘরে হামলা চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

 

আমাদের অনেক ঘরবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ধর্মীয় সম্প্রীতির জেলায় আমাদের এখন আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে। এদিকে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বিভিন্ন ইউনিটকে ফেসবুকে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

 

পাশাপাশি ফেসবুক গুজব পরিচালনকারীর বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেয়ারও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ওই নির্দেশনায় আরো বলা হয়, একটি চক্র পঞ্চগড়ের বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে।

 

এর জন্য তারা ফেসবুককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাচ্ছে। এ কারণে সতর্ক থেকে ফেসবুকের মনিটরিং আরো জোরদারসহ যারা এ ধরনের গুজব ছড়াব তাদের আইনের আওতায় আনার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

 

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজমের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন, পঞ্চগড়ে যারা ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে জনগণকে উসকে দিয়েছে ইতোমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু হয়েছে। আমরা ফেসবুকে কিছু আইডি চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার অভিযানও পরিচালনা করছি।

 

এছাড়া মনিটরিংও জোরদার করা হয়েছে। যারাই গুজব ছড়াবে তাদেরই আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, আমরা কোনোভাবেই চাই না গুজবের কবলে পড়ে কোনো ঘটনা ঘটুক। তাই সতর্ক করা হয়েছে কেউ গুজব ছড়ালে অবশ্যই তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।

 

গুজব ছড়িয়ে হামলার ঘটনা: ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার জেলার রামুতে ফেসবুকে একটি ছবি ট্যাগ করা নিয়ে বাধে তুলকালাম কান্ড। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এক যুবকের ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার জের ধরে রামুতে বৌদ্ধ স্থাপনা ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা হয়। ১০টিরও বেশি বৌদ্ধ বিহার ও প্রায় ২৫টি বাড়িতে চলে হামলা-ভাঙচুর।

 

পরের ঘটনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে। রামুর কায়দাতেই ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর আক্রান্ত হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। সে সময় অভিযোগ করা হয়, রসরাজ নামে এক ব্যক্তি ফেসবুকে ইসলামবিদ্বেষী ছবি প্রকাশ করে।

 

অথচ আড়াই মাস পর জানা যায়, রসরাজ ফেসবুকে চালাতে জানে না। ব্রাহ্মণবাড়িয়া নাসিরনগরে হামলার এক বছর পর ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর রংপুরের গঙ্গাচড়ায় ফেসবুক থেকে ছড়ানো গুজবের জেরে একজনের মৃত্যু হয়।

 

অভিযোগ সেই একই, হিন্দু তরুণের ফেসবুকে থেকে নবীকে অবমাননার অভিযোগ। ২০১৯ সালে ভোলার বোরহানউদ্দিনে একটি কথিত বক্তব্য দিয়ে তৈরি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে ঘটে সহিংস বিক্ষোভ। এ ঘটনায় চারজন নিহত হন। আহত হন ১০ পুলিশসহ প্রায় ১৫০ জনেরও বেশি।

 

২০২০ সালের নভেম্বরে কুমিল্লার মুরাদনগরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক ব্যক্তির ফেসবুকে কমেন্টের জেরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়ি ঘর, উপাসনালয়ে হামলা এবং ভাঙচুর হয়।

 

হেফাজত নেতা মামুনুল হককে উদ্দেশ করে দেয়া এক হিন্দু ব্যক্তির স্ট্যাটাসের কারণে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার একটি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে হামলা ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় কয়েক হাজার মানুষ। কুমিল্লায় নানুয়ারদীঘি এলাকার একটি পূজামন্ডপের প্রতিমাকে ঘিরে ধর্মীয় বিতর্কিত ছবি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

 

গত বছরের শেষের দিকে নড়াইলের লোহাগড়ায় আকাশ সাহা নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে অসম্মান করে একটি পোস্ট দেয়া হয়। এমন পোস্ট দেখার পরে আশপাশের কয়েকটি গ্রামের লোকেরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। জুমার নামাজের পরে স্থানীয়রা আকাশের বাবা অশোক সাহার মুদি দোকানে গিয়ে ছেলের খোঁজ করে। তাকে না পেয়ে দোকানে ভাঙচুর চালায়।

 

বিকেলের পর আকাশের বাড়ি সাহাপাড়ায় হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা। একপর্যায়ে তারা সাহাপাড়ার মন্দিরের ভেতরে ঢুকে আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। এর আগে মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজে রাহুল দেব নামে একাদশ শ্রেণির এক ছাত্র নুপুর দেবকে সমর্থন করে ফেসবুকে পোস্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে রণক্ষেত্র তৈরি হয়।

 

শিক্ষক স্বপন কুমার ওই ছাত্রের পক্ষ নিয়েছেন এমন অভিযোগ তুলে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা শিক্ষকদের তিনটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসসহ অভিযুক্ত ছাত্রকে জুতার মালা পরিয়ে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়।

 

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, মাঝে মাঝে এলাকাভেদে কিছু প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ফেসবুকে ভুয়া আইডি বানিয়ে ধর্মীয় অনুভ‚তিতে আঘাত হানার মতো পোস্ট করছে। সেই পোস্টগুলো নিয়ে শুরু হচ্ছে উত্তেজনা। একপর্যায়ে হামলা, ভাঙচুর, আগুন; এমনকি লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে।

 

কর্মকর্তারা বলছেন, দেশ এবং দেশের বাইরে থেকে এ ধরনের উসকানি বা গুজব তৈরি করে সহিংসতা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন আইডি থেকে একের পর এক পোস্ট করা হচ্ছে। এমনকি মন্ত্রী-এমপি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ে কুৎসা রটনামূলক শত শত পোস্ট করা হচ্ছে। এমন অবস্থায় ওই আইডি ও মাঠ পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

 

সিআইডির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, বরাবর কিছু চিহ্নিত আইডি থেকে সরকারবিরোধী নানা পোস্ট করা হয়। এছাড়া সমসাময়িক বিষয় নিয়েও উসকানিমূলক পোস্টও দেয়া হয় ওই আইডিগুলো থেকে। ওই আইডিগুলোকে চিহ্নিত করে মাঝে মাঝে অপারেশন চালানো হয়। গ্রেপ্তার করা হয় আইডি পরিচালনাকারী ব্যক্তিদের।

 

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা অবগত রয়েছি। পরিস্থিতির ওপরও নজর রাখা হয়েছে। কোথাও কোনো ইনসিডিন্টে হলে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া যায় সে ব্যাপারেও আমরা কাজ করছি। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রফেসর ড. কুদরাদ ই খুদা বাবু বলেন, আমরা লক্ষ করেছি একটি গোষ্ঠী এ ধরনের সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন।

 

সংঘবদ্ধভাবে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ধর্মপ্রাণ মানুষের উত্তেজিত করে এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। তিনি বলেন, এজন্য সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।

 

দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলেই শুধু এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে।

 

ভোরের আকাশ/নি