শিপংকর শীল: দেশে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে বহুমাত্রিক উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে সরকার। দেশের নারীরা বহু ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছেন বলে জানিয়েছে শিশু ও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়। কিন্তু আমাদের সমাজে তারা এখনো ব্যাপকভাবে বঞ্চিত, নিগৃহীত, নির্যাতিত ও অবহেলিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সর্বত্র নারীর শুধু অংশগ্রহণ বাড়ালেই চলবে না, তার গুণগত উন্নয়ন জরুরি। কোনো দেশের উন্নয়নের জন্য নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন গুরুত্বপূর্ণ। নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। কারণ তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতায় এখনো অবহেলিত। নারীর অনানুষ্ঠানিক কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করা দরকার। কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ সংবেদনশীল পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
শিশু ও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানায়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মাধ্যমে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে বহুমাত্রিক প্রকল্প চালু রয়েছে। আর ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে অনেক প্রকল্প। বর্তমানে শিশু ও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রাম-চতুর্থ পর্ব শীর্ষক প্রকল্প, ইনকাম জেনারেটিং একটিভিটিস ফর উইমেন এট উপজেলা লেবেল (দ্বিতীয় সংশোধিত পর্ব), কিশোর-কিশোরী ক্লাব স্থান, জেলাভিত্তিক মহিলা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, মহিলাদের তথ্য প্রযুক্তির ক্ষমতায়ন, তৃণমূল পর্যায়ে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে নারী উদ্যোক্ততাদের বিকাশ সাধন, জয়িনতা টাওয়ার নির্মাণ (প্রথম সংশোধিত), জয়িতা ফাউন্ডেশনের সক্ষমতা বিনির্মাণ প্রকল্প, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল ও ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন ইত্যাদি।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় জানায়, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, যাদের অধিকাংশই পল্লী অঞ্চলে বসবাসকারী সুবিধাবঞ্চিত। এ সকল নারীদের ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি তথা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণাধীন সমাজসেবা অধিদপ্তর ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ হতে পল্লী মাতৃকেন্দ্র কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে। নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে অনগ্রসর, বঞ্চিত, দরিদ্র ও সমস্যাগ্রস্ত নারীদের সংগঠিত করে পরিবার ভিত্তিক দরিদ্রতা হ্রাস করা হচ্ছে। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে উপজেলা পর্যায়ে গ্রাম এলাকার লক্ষ্যভুক্ত নিম্ন আয়ের অনগ্রসর দরিদ্র নারীদের সংগঠিত করে তাদের নিজস্ব পুঁজি গঠন করা হয়। শুধু জন্মদানে সক্ষম নারীদের অংশগ্রহণে পল্লী মাতৃকেন্দ্র কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশের ৬৪ জেলার ৪৯২টি উপজেলায় এ কর্মসূচি চালু রয়েছে। পল্লী মাতৃকেন্দ্রের মূল লক্ষ্য হচ্ছে গ্রামের দরিদ্র নারীদের ছোট পরিবার গঠনের উপকারিতা, বয়স্ক শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, মা ও শিশুযত্ন সম্পর্কে অবহিত এবং উদ্বুদ্ধকরণের পাশাপাশি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান, সঞ্চয় সৃষ্টি ও অর্থকরী লাভজনক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা। প্রতিজন সদস্যকে ৫ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করা হয়। ১০% সার্ভিস চার্জসহ সমান ১০টি কিস্তিতে সর্বোচ্চ ১ বছর মেয়াদে এ ঋণ পরিশোধযোগ্য।
বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় জানায়, নারী-পুরুষ সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়নকে আমলে নিয়েই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড পরিচালনাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বিগত কয়েক বছর ধরে। এক্ষেত্রে দুটি প্রভাবশালী মন্ত্রণালয় হচ্ছে বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য মন্ত্রণালয়। এতকাল ধরে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পে বরাদ্দ বৃদ্ধি করে এবং নতুন কিছু নিরাপত্তা প্রকল্প গ্রহণ করে ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ অর্জন করার প্রয়াস নেয়া হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং তথ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা হচ্ছে সাহায্যমূলক কর্মসূচির বাইরে সবচাইতে প্রভাবশালী ক্ষেত্র, যার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন ত্বরান্বিত হতে পারে। তাই এই দুটি ক্ষেত্রে নারীর প্রবেশ কতটুকু ঘটেছে এবং দেশের জাতীয় বাজেট এসব বিষয়ে নারীর প্রবেশকে কতটা সহায়তা প্রদান করেছে তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের নারীরা সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে যাচ্ছে। প্রথম নারী ভিসি, প্রথম নারী পর্বতারোহী, বিজিএমইএর প্রথম নারী সভাপতি, প্রথম মেজর, প্রথম নারী স্পিকার, প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিগত এক দশকে সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর যথাযোগ্য অবস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানে নারীর অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষা করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধারা সন্নিবেশ করা হয়েছে। সর্বোপরি নারীদের প্রতি ইতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির মাত্রা আরো বাড়াতে হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ- সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন সাংবাদিকদের বলেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫০ বছরে বাংলাদেশে অর্থনীতির পট পরিবর্তনে একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ। এই পাঁচ দশকে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের সফলতায় বড় অবদান রেখেছেন নারীরা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে এসে এখন গর্ব করে বলা যায়, পাকিস্তানকে যেসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পেছনে ফেলেছে, তার একটি হলো কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ।
কর্মক্ষেত্রে নারী : স্বাধীন দেশের শ্রমবাজারে ধীরে ধীরে বেড়েছে নারীর অংশগ্রহণ। তবে শ্রমবাজারে নারীর একটা বড় অংশই অনানুষ্ঠানিক বা নিম্নআয়ের ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। গত ৫০ বছরে নারীরা দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় বলা হয়, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ। তবে সংসারের ভেতর ও বাহিরের কাজের মূল্য ধরা হলে নারীর অবদান বেড়ে দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ। এর অর্থ হলো, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারী-পুরুষের অবদান বলা যায় সমান-সমান।
বিবিএসের সর্বশেষ জরিপ তুলে ধরে শ্রম মন্ত্রণালয় জানায়, ১ কোটি ৮৭ লাখ নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা-অর্থনীতির বৃহত্তর এই তিন খাতে কাজ করছেন। তবে উৎপাদন ব্যবস্থায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও নারী কর্মীদের সিংহভাগই শ্রমজীবী, বাকিরা শিক্ষকতা, চিকিৎসা, ব্যাংকিং, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা পেশায় যুক্ত, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীসহ বিভিন্ন উচ্চ পদেও দায়িত্ব পালন করছেন নারীরা। তবে শ্রমবাজারে নারীর একটা বড় অংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত। যেমন- কর্মজীবী নারীদের অর্ধেকের বেশি কৃষিকাজে সম্পৃক্ত। আরেকটি বড় অংশ পোশাকশিল্পে কাজ করে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় নারীর অংশগ্রহণ কম।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ নারী আছেন। তবে উপসচিব থেকে সচিব পর্যায়ে নারীর সংখ্যা ১ শতাংশ বা তারও কম। দেশে সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত পদেও নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় অনেক কম। এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে পোশাক খাতে কাজ করা ৪০ লাখ শ্রমিকের ৫৯ দশমিক ১২ শতাংশ নারী।
বৈষম্য : লিঙ্গবৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ধারাবাহিক উন্নতি করেছে। এই বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ, যা বিগত কয়েক বছরের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট’ পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই। কিন্তু করোনা-পরবর্তী সময়ে গত এক বছরে দেশে এই বৈষম্য বেড়েছে। বৈশ্বিকভাবে অবনমন ঘটলেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ে নারীর অবস্থান, শিক্ষায় সমান সুযোগ এবং কর্মসংস্থানে নারীর এগিয়ে যাওয়ায় অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়ে।
রাজনীতিতে নারী : বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদশের রাজনীতিতে বহুদিন ধরে নারী নেতৃত্ব চললেও সার্বিকভাবে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ সুখকর নয়। মানুষ হিসেবে, দেশের নাগরিক হিসেবে নারীর অধিকার আছে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা মানে কিন্তু পুরুষের মতো হতে চাওয়া নয়, পুরুষ ও নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা। নারীর জীবন নিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা এখনো এই দুই হাজার একুশ সালেও সীমিত। কোনো যোগ্য নারী এখনো চাইলেই তার মতামত প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পান না, বরং পরিবার থেকে, রাষ্ট্র থেকে তীব্র বাধার সম্মুখীন হন। এই বাধা অতিক্রম করে নারীকেই এগোতে হবে। শ্রেণি ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে নারীরা আজও রাজনৈতিক ক্ষমতা ও নীতিনির্ধারণ থেকে অনেক দূরে।
পুরুষের তুলনায় নারীদের গড় আয়ু বেশি : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে নারীর গড় আয়ু ৭৪.২ বছর। আর পুরুষের ৭১.১ বছর। অর্থাৎ নারীর গড় আয়ু পুরুষের তুলনায় প্রায় তিন বছর বেশি।
ভোরের আকাশ/আসা