এক
পৃথিবীজুড়ে মরণঘাতী করোনাভাইরাসের ভয়াল তান্ডব। বিশ্বের প্রায় দুইশ দেশে আঘাত হেনেছে ভাইরাসটি। যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, ইতালি পেরিয়ে করোনা পৌঁছে গেছে বাংলাদেশে। ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর দেশজুড়ে বাড়তি সর্তকতা অবলম্বন করা হয়েছে। মুজিববর্ষের সব অনুষ্ঠান বাতিল করাসহ ২৬ মার্চ থেকে চলছে সাধারণ ছুটি। রাস্তা-ঘাটে যান চলাচলও বন্ধ। চলছে সেনাবাহিনী ও পুলিশের টহল।
ছোঁয়াছে এ ভাইরাস যাতে অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে না পারে, সেজন্য মহল্লায় মহল্লায় তৈরি করা হয়েছে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। তারাও নিজেদের মতো করে এলাকা সামাল দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ফলে বিশেষ দরকার ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। লকডাউন উপেক্ষা করে তবুও বেরিয়েছেন আলম সাহেব। বেরিয়েছেন নিজের গাড়ি নিয়ে।
উদ্দেশ্য নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটা। বাসার জন্য চাল, ডাল, তেল, লবণসহ অন্যান্য সামগ্রী দরকার। এছাড়া গৃহকর্মী এবং ড্রাইভারের পরিবারের জন্যও কিছু কেনাকাটা করে দেবেন। ইতোমধ্যে গৃহকর্মীকে ছুটি দেয়া হয়েছে। আজকের পর ড্রাইভারকেও ছেড়ে দেয়া হবে। সে জন্যই এত তাড়া। তাছাড়া দেশ-বিদেশ থেকে প্রতিদিনই মৃত্যুর খবর আসছে। ইতালি, যুক্তরাজ্যে প্রতিদিনই প্রায় হাজারের ওপরে লোক মারা যাচ্ছে।
তাই নিজ পরিবার এবং অন্যকে যতটা নিরাপদে রাখা যায়, ততই ভালো। কেনাকাটা শেষ করে বাসায় ফেরার পথে ফার্মেসিতে নামেন আলম সাহেব। ড্রাইভারকে বলে দেন গৃহকর্মীর বাসায় তার বাজার পৌঁছে দিয়ে আসতে। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে গৃহকর্মীর বাসার দিকে চলে যায়।
বাজার পৌঁছে দিয়ে তাকে আবার আলম সাহেবের বাসায় আসতে হবে। তারপর যেতে হবে নিজের বাসায়। পরে গাড়ি গ্যারেজে রেখে আসতে হবে। ফাঁকা রাস্তায় তাই গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয় ড্রাইভার মতিন।
দুই
কাকভেজা হয়ে বাসায় ফেরেন আলম সাহেব। তার হাতে বেশ বড়সড় একটা ব্যাগ। কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে দেয় স্ত্রী শশী। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে, অনেকক্ষণ ধরে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছে। স্বামীকে এ অবস্থায় দেখে একটু অবাক হয়। সঙ্গে ড্রাইভারের থাকার কথা। অবাক হওয়ার কারণ সেটাই।
কী ব্যাপার এই কাকভেজা হয়ে তুমি কোথা থেকে এলে? স্বামীকে শশীর প্রশ্ন।
কোথায় যাব আবার। বাজারে গিয়েছিলাম। আমাদের বাজারের পাশাপাশি আছিয়া খালা এবং মতিনের জন্য কিছু কেনাকাটা করলাম। গরিব মানুষÑ এই সময়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো দরকার। মতিন গিয়েছে খালার বাসায় বাজারগুলো দিয়ে আসতে। বলতে বলতে ভেতরে গিয়ে চেয়ারে বসেন আলম সাহেব।
ওদের জন্য বাজার করে ভালোই করেছ। আমিই ভেবেছিলাম তোমাকে বলব। কিন্তু এই বৃষ্টির মধ্যে পথে নামতে গেলে কেন। তোমাকে পৌঁছে দিয়ে মতিন পরে খালার বাসায় যেত। তোমার তো ঠান্ডা লেগে যাবে।
নেমেছিলাম দরকারে। আরও কিছু কেনাকাটা বাকি ছিল।
মতিনকে বললেই পারতে। তোমার নামার দরকার ছিল না।
আলাম সাহেব হাসেন। শশী- সবকিছু কি ড্রাইভার পিওন দিয়ে কেনানো যায়? কিছু কাজ নিজেরই করা উচিত।
কী এমন হাতি কিনতে গিয়েছিলে, যা মতিনকে দিয়ে করানো যাবে না।
ফার্মেসিতে গিয়েছিলাম। কিছু দরকারি ওষুধ নিয়ে এলাম। সাথে দুই বক্স নিয়ে এলাম। দরকারি জিনিস তো মিস করলাম না।
তার মানে কী। তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এত দিয়ে করবেটা কী। এগুলো কি আজই বাজার থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে? নাকি চাল-ডালের মতো এটাও ত্রাণ দেবে?
আবারো হাসেন আলম সাহেব। তুমি তো কোনো খবরই রাখ না। শোনো, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কনডম উৎপাদন হয় মালয়েশিয়ায়। বিশ্বে যত কনডমের চাহিদা তার পাঁচটির একটিই ওরা তৈরি করে। কোম্পানির নাম কারেক্স। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বন্ধ। ইতোমধ্যে অনেক জায়গায় জিনিসটির সংকট তৈরি হয়েছে। তাই আমি বুদ্ধি করে নিয়ে আসলাম, ভালো করিনি বল? আর এটা কিন্তু একটা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, ত্রাণ হিসেবে দিলে মন্দ হয় না। হা হা হা।
তুমি না আস্ত একটা পাগল। দিন দিন ভিমরতি আরো বাড়ছে। যাও ফ্রেশ হয়ে আস। সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধোবে কিন্তু।
কী যে বল শশী। আমার বয়স এখন তেতাল্লিশ। তাহলে ষাট বছরে কী বলবে। এই যে সবাই হোম কোয়ারেন্টাইনে আছে না, এক বছর পরে দেখবে এর ফলাফল। করোনায় যত লোক মারা যাবে, বছর শেষে জন্ম নেবে তারচেয়ে বেশি শিশু। এই যে জন্মনিয়ন্ত্রণের সরমঞ্জামের সংকট, এটা সম্ভবত প্রকৃতির খেয়াল। পৃথিবী থেকে একদল নিয়ে যাবে আর এক দল পাঠাবে।
হয়েছে আর দার্শনিকের মতো সংলাপ দিতে হবে না। যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।
স্ত্রীর কথামতো ওয়াশরুমের দিকে চলে যান আলম সাহেব।
তিন
ফ্রেশ হয়ে ছেলে হিমেলের ঘরে যান আলম সাহেব। হিমেলের বয়স তের বছর। পড়ছে ক্লাস সেভেনে। সে পড়ালেখায় বেশ ভালো। কোয়ারেন্টাইনের সময় পাঠে মনোযোগ আরো বেড়েছে। এখনো পড়ছে সে। তবে এটা ক্লাসের বই নয়। বাংলা সাহিত্যের একটি বিখ্যাত বই। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী। আলম সাহেব ছেলের থেকে বেশ দূরত্ব রেখে বসেন। হিমেল হাসে। আব্বু তুমি তো এখন আর আমার কাছে আসোই না। তোমার খুব করোনাভাইরাসের ভয় তাই না?
ঠিক ভয় নয় বাবাই, সর্তক থাকা। এই ভাইরাসটির স্বভাব খুব খারাপ। দুষ্ট ভাইরাস। দ্রুত একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরের ছড়ায়। তারপর হাতের মাধ্যমে গলায় আক্রমণ করে। তাই একটু সর্তক থাকাই ভালো। তোমার শরীর কেমন?
জি আব্বু ভালো। শুনলাম তুমি নাকি ভিজে ভিজে এসেছ। তোমার আবার ঠান্ডা লেগে না যায়।
না না কিচ্ছু হবে না। দুধ খেয়েছিলে, তোমার আম্মু গরম দুধ দিয়েছিল তো?
হ্যাঁ আব্বু আমি ওকে আছি। তুমি এখন যাও। ডিস্টার্ব করো না। একটা মজার বই পড়ছি। আজকেই শেষ করে ফেলব।
তাই নাকি, কী বই?
পথের পাঁচালী। সোনার কেল্লা শেষ হয়ে গেছে। এখন এটা পড়ছি।
খুব ভালো। এসব বই অবশ্যই পড়া দরকার। মুভিগুলো দেখতে বলেছিলাম, দেখেছিলে?
না আব্বু এগুলো তোমার সাথে দেখব। নামগুলো মনে আছে? পুরস্কার, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, দিপু নাম্বার টু, আমার বন্ধু রাশেদ, ছুটির ঘণ্টা, বাড়ি থেকে পালিয়ে, ডানপিটে ছেলেÑ সবগুলো মনে আছে। এখন যাও তো।
হাসতে হাসতে নিজের ঘরে চলে আসেন আলম সাহেব। ল্যাপটপ ওপেন করে ফেসবুক নিয়ে বসেন। এখন ফেসবুক থেকেই অনেক সংবাদ পাওয়া যায়। করোনার আপডেট তিনি এখান থেকেই পাচ্ছেন। কিছু ভালোমানের পত্রিকায় লাইক দিয়ে রেখেছেন তিনি, সেজন্য আপডেট পেতে আরো সুবিধা।
দ্য পিপল ইউ নো অপশনে একটা ছবি দেখে অবাক হন আলম সাহেব। একুশ-বাইশ বছর বয়সি ছেলেটার চেহারা একেবারে তার মতো। তার যৌবনের চেহারার সাথে ছেলেটার চেহারা মিলে যায়। লিও গোমেজ নামে ছেলেটার আইডিতে ঢোকেন আলম সাহেব। অন্যান্য ছবি দেখে আরো অবাক হন।
এমন হয় নাকি! ছেলেটার চুল কাটানোর স্টাইল, চাহনি, এমনিকি পোশাক সবকিছুর সাথে নিজের অদ্ভুত মিল পাচ্ছেন তিনি। আলম সাহেব ছেলেটাকে রিকোয়েষ্ট পাঠান। কিছুক্ষণ পর কফি নিয়ে ঘরে ঢোকে শশী। স্বামীর দিকে কফির কাপ এগিয়ে দেয়, এই নাও।
কফিতে চুমুক দিয়ে শশীকে ছবিটা দেখান আলম সাহেব। বল তো এই ছবিটা কার?
কার আবার, তোমার ছাত্র বয়সের ছবি। কিন্তু এই ছবিটা তো আগে কখনো দেখিনি।
একটু ভালো করে দেখে বল।
ছবিটা খঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে শশী। এটা তোমার ছবি। তুমি দেখতে আসলে আগে অনেক সুন্দর ছিলে।
পৃথিবীতে কোনো কিছুই স্থায়ী না শশী। এই তুমি-আমি কেউ আগের মতো নেই। দিন দিন বদলাচ্ছি। এটাই নিয়ম। কিন্তু এই ছবিটা আমার নয়। ছেলেটা খ্রিষ্টান। ওর ছবিটা দেখে প্রথমে আমিও চমকে গেছি। এত মিল হয় কীভাবে?
শুনেছি একই ধরনের চেহারার মানুষ নাকি পৃথিবীতে চারজন করে আছে। সে রকম কিছু হবে হয়তো। শশী উত্তর দেয়।
চার
লিও গোমেজ নামে ছেলেটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেছে। তার সঙ্গে নিয়মিত চ্যাটিং হচ্ছে আলম সাহেবের। ছেলেটাও আলম সাহেবের ছবি দেখে অবাক। সে জন্য তার আগ্রহটা একটু বেশিই।
লিওরা গুলশানে থাকে। ও
দের গ্রামের বাড়ি বগুড়ায়। বহুদিন হয় আমেরিকায় স্থায়ী হয়েছে। স্বপনের বাবা ক্যালেফোর্নিয়ায় একটা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক। স্বপনও ওই বিশ্ব বিদ্যালয়ে পড়ছে। আর দুই বছরের মধ্যে লেখাপড়া শেষ হবে। কিছুদিন আগে মাকে সঙ্গে নিয়ে দেশে বেড়াতে এসেছে তারা। এসে করোনার লকডাউনে আটকে গেছে।
বয়সের পার্থক্য হলেও লিও আলম সাহেবকে বন্ধু হিসেবে নিয়েছে। তাকে তুমি সম্বোধন করে। আলম সাহেবও খুশি, এ বয়সে এসে একটা নতুন বন্ধু পাওয়া গেছে। সারাদিন বাসায় থাকার কারণে প্রায় চ্যাটিং হচ্ছে তাদের। একটা পর্যায়ে তারা মেসেঞ্জারে কল দিয়ে কথা শুরু করে। সেল নাম্বারও আদান-প্রদান হয়। তাদের কথোপকথন খুব স্বাভাবিক, কী করছো, কী খেয়েছো, বাসার সবাই কেমন আছে, বাবার সঙ্গে যোগাযোগ হয় নাকি এসব।
লিওর সঙ্গে সখ্যের বিষয়টি শশী এবং হিমেল দুজনই জানে। হিমেলের সঙ্গেও কয়েকবার কথা বলেছে লিও। পরে আলম সাহেবের কাছে প্রশংসা করেছে, তোমার ছেলেটা খুব কিউট। খুব ভালো ছেলে। কয়েক দিনে আলম সাহেব বুঝে গেছেন লিও ছেলেটা দারুণ মিশুক।
খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে। তার ব্যক্তিগত অনেক কথাই আলম সাহেবের সাথে শেয়ার করেছে। লিও তার বিশ্ব বিদ্যালয়ের একটি মেয়েকে ভালোবাসে। মেয়েটা ওর থেকে তিন বছরের সিনিয়র। চলতি বছরের শেষদিকে বিয়ে করবে ওরা।
করোনায় দুজন দুদেশে থাকায় প্রায় লিওর মন খারাপ থাকে। তখন আলম সাহেবকে নক করে। সময় নিয়ে কথা বলে। আলম সাহেব এতে বেশ খুশি। এই সময়ে একজন কথা বলার লোক পাওয়াতে ভালোই হয়েছে। সময়টা কেটে যাচ্ছে। কথা শেষ করার পর প্রতিদিনই স্ত্রীর কাছে লিওর আপডেট জানান আলম সাহেব। করোনা শেষ হলে তাদের দুই বন্ধুর দেখা হবে। ছেলেটাকে দেখার আগ্রহ শশীরও।
সে স্বামীকে বলেছে, দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে লিও ও তার মাকে বাসায় নিমন্ত্রণ করতে। বাইরে দেখা করার চেয়ে বাসাই ভালো। সময় নিয়ে কথা বলা যাবে। পাশাপাশি নতুন একটা পরিবারের সাথে পরিচয় হবে। স্ত্রীর কথায় মত দেন আলম সাহেব।
পাঁচ
লিওদের ফিরে যাওয়ার কথা ছিল বিশ্ব পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে। কিন্তু তার আগে আমেরিকা থেকে আসা একটি বিশেষ বিমানে দেশ ছাড়ার সুযোগ হয় তাদের। বিষয়টি আলম সাহেবকে জানায় লিও। আগামী সোমবার তাদের ফ্লাইট। হাতে তিন দিন সময়। এর মধ্যে সব গুছিয়ে নিতে হবে। আলম সাহেবের খারাপ লাগে।
ছেলেটার সঙ্গে সম্ভবত আর দেখা হবে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এর মধ্যে এক দিন তাদের সঙ্গে দেখা করা যেত। কিন্তু এখন কোনো কিছুই অনুকূলে নেই। গ্রাম কি শহর কোথাও কারো বাড়িতে কেউ যাচ্ছেন না। তাই ইচ্ছে থাকলেও দেখা হচ্ছে না লিওর সঙ্গে ।
এর মধ্যে লিও জানায়, অল্প সময়ের জন্য তারা একবার আলম সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চায়। তার মা-ই এ অনুরোধ করেছেন। আলম সাহেব দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েন। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। পরে বিষয়টি স্ত্রীর কাছে শেয়ার করেন। শশী বলে, ওরা দেশের বাইরে চলে যাবে। আর কবে আসবে তার ঠিক নেই। হয়তো আর কখনো দেখাই হবে না। তার চেয়ে তুমি বাইরে কোথাও ওদের সঙ্গে দেখা কর।
রোববার সকালে লিওদের ফ্ল্যাটে যান আলম সাহেব। লিও তাকে মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। দূরত্ব বজায় রেখে বসেন সবাই। কুশলাদি বিনিময় হয়। লিওর আম্মা আগেই কিছু নাশতা বানিয়ে রেখেছে, সেগুলো পরিবেশন করেন। করোনা পরিস্থিতি ভুলে গিয়ে তিনজনের আলাপ জমে যায়। এর মধ্যে লিওর গার্লফ্রেন্ডের ফোন আসে। সে আলম সাহেবের অনুমতি নিয়ে ছাদে কথা বলার জন্য চলে যায়।
এতক্ষণ লিওর আম্মা আই কন্ট্রাক করে কথা বলেননি। এবারই প্রথম আলম সাহেবের চোখে চোখ রাখেন। হেসে বলেন, আপনি কি আমায় চিনতে পেরেছেন?
তার কথা শুনে আলম সাহেব হোঁচট খান। ভদ্রমহিলার সঙ্গে তার কখনো দেখাই হয়নি, চেনার প্রশ্ন আসছে কেন।
চিনতে পারেননি তাই না? আবারো লিওর আম্মার প্রশ্ন।
না। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আপনাকে কখনো কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।
আমার ভুল হচ্ছে না আলম সাহেব। হাসমতের মেসের কথা মনে আছে, কদমতলা লেন?
হ্যাঁ আমরা তো ওই মেসে দীর্ঘদিন ছিলাম।
কতদিন হয় ওই মেস ছেড়েছেন?
সে তো বহুদিন আঠার-উনিশ বছর।
আপনাদের মেস মেম্বার ফজলু, সিরাজ ওদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে?
না এখন আর কারো সঙ্গে যোগাযোগ নেই। কিন্তু আপনি এতসব জানলেন কী করে?
মিলি বউদির কথা আছে?
হ্যাঁ। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে কিছুদিন ছিলেন, বছরখানেক হবে। আপনার কি বউদির কাছে যাওয়া-আসা ছিল?
আলম সাহেব আমিই মিলি। ভালো করে চেয়ে দেখেন তো চিনতে পারেন কিনা?
আলম সাহেব লজ্জা পান। বউদি আপনাকে তো চেনাই যায় না। আর এতদিন পরে আমাদের দেখা হবে সেটা তো কখনো ভাবিইনি। আসলে মানুষ বলে না পৃথিবীটা গোল। ঘুরতে ঘুরতে এক দিন ঠিক দেখা হয়ে যায়।
আপনি তো আমায় ভুলেই গিয়েছিলেন তাই না?
ঠিক তা নয়। যাপিত জীবনে অনেকবারই আপনার কথা মনে হয়েছে কিন্তু কখনো দেখা হবে ভাবিনি। আপনাকে একেবারেই চেনা যায় না বউদি।
আমি কিন্তু আপনাকে ছবি দেখেই চিনেছি। বাবু যে দিন প্রথম আপনার ছবি দেখায় সে দিনই ঠিক করি আপনার সঙ্গে দেখা করব। জীবনে একবার হলেও আপনার সঙ্গে আমার দেখা হওয়া জরুরি ছিল।
একুশ-বাইশ বছর আগের কথা মনে পড়ে আলম সাহেবের। তিনি লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখেন।
মিলি বউদি বলে, আলম সাহেব একুশ-বাইশ বছর আগের সেই দুদিনের ঘটনায় আপনার কোনো দোষ ছিল না। আর আমিও তেমন নারী নই। বাধ্য হয়েই আমি আপনার কাছে গিয়েছিলাম। কারণ আমি আমার স্বামীকে খুব বেশি ভালোবাসতাম, এখনো বাসি। আমাদের বিয়েটা ভালোবেসে। কিন্তু বিবাহিত জীবনের বহুদিন পেরিয়ে গেলেও আমাদের সন্তান আসছিল না।
পরে জানতে পারি আমার স্বামী কখনো বাবা হতে পারবে না। বিষয়টি আজো জানতে পারেনি ও। মানুষটা একটা সন্তানের জন্য সারাক্ষণ আফসোস করত। প্রায় প্রতিদিনই বলত। আমি ওর মুখের দিকে তাকাতে পারতাম না। খুব কষ্ট হতো। ভেবেছিলাম মিথ্যে করে হলেও ওকে সন্তানের সুখ দেব। তাই আপনার সঙ্গে ওই ঘটনাটি ঘটিয়েছিলাম। আমি জানি না এটা ঠিক ছিল নাকি ভুল। হয়তো ভুলই ছিল। সেদিনের ঘটনার জন্য আমায় ক্ষমা করে দেবেন আলম সাহেব।
মিলি বউদির কথা শুনে আলম সাহেবের শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। বারবার মনে হচ্ছে লিওর সঙ্গে তার পরিচয় না হলেই ভালো হতো। এখন কী করবেন তিনি। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেনÑ এ ঘটনার কি কোনো সমাধান আছে? স্বপনকে অস্বীকার করার কোনো সুয়োগ আছে কি?
দুজনেই নীরব। সে দিনের কথা মনে পড়ছে আলম সাহেবের। তখন একুশ-বাইশ বছরের যুবক। অনার্স থার্ড ইয়ার কিংবা ফাইনাল ইয়ারে পড়েন। অন্যদের সঙ্গে পল্টনের একটি মেসে থাকতেন। মিলি বউদি তার স্বামীকে নিয়ে থাকতেন পাশের ফ্ল্যাটে। কারণে-অকারণে মিলি বউদি তাদের ঘরে যেতেন। এটা-ওটা রান্না করে খেতে দিতেন। এক দুপুরে তার ঘরে আসেন মিলি বউদি।
তখন অন্য কেউ ছিলেন না। সেদিন মিলি বউদি একবারেই অন্যভাবে এসেছিলেন। আলম সাহেবও ছিলেন অন্য মনস্ক। ইচ্ছেটা বউদির বেশি ছিল। সুযোগটা তিনিই দিয়েছিলেন। পরের দিন একই সময়ে আবার উপস্থিত বউদি। সেদিনও একই ঘটনা ঘটেছিল। এর পর গ্রীষ্মের ছুটিতে গ্রামে চলে যান আলম সাহেব। ফিরে এসে আর বউদিকে পাননি। শশী ছাড়া মিলি বউদি তার জীবনে একমাত্র নারী।
কথা শেষ করে ফিরে আসে লিও। আলম সাহেব একদৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকে। করোনার বাধা ভেঙে বুকে জড়িয়ে ধরে লিওকে। কপালে স্নেহের চুম্বন এঁকে দেয়। তারপর কেটে যায় আরো তিন ঘণ্টা। পুরোটা সময়ই লিওর হাত ধরে বসে থাকে আলম সাহেব। মাঝে মাঝে গায়ে মাথায় হাত বোলায়। দুচোখ ভরে দেখে লিওকে। ভাবে পৃথিবী এমন কেন। এই অধিকার কী করে ছেড়ে যাবে সে। এর কি কোন সমাধান নেই?
লিও এবং তার আম্মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসে আলম সাহেব। ভাবে কথাটা তিনি স্ত্রীর কাছে বলবে। পরে মত বদলায়। মানুষের জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যা সারা জীবন আড়ালে থেকে যায়। যা কখনো কেউ জানতে পারে না। তার ঘটনাটাও এভাবে আড়ালে থাকুক।
ঘটনা আড়াল রাখলে লিও, তার বাবা, মিলি বউদি, শশী, হিমেল সবাই যদি ভালো থাকে সেটা মন্দ কী। কিছু ঘটনা পৃথিবী আড়াল করে রাখতেই ভালোবাসে। এটা এক অদ্ভুত রহস্য।
ভোরের আকাশ/নি